পথ গিয়েছে পাথরায়
পলাশ মুখোপাধ্যায়
##
মনটা আবার পালাই পালাই। কয়েকটা দিন একটু ঠিকঠাক ছিল বটে, কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরবার পথে একচিলতে কাশ ফুল দেখেই ফের মনের মধ্যে কুলবুলিয়ে উঠল। কাশফুলের দেখা পেতে গেলে নদীর ধার সব চাইতে ভাল জায়গা। নদীর জলে কাশের ছায়া, সে এক মায়াবী ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু এদিককার এই শহর ঘেঁষা নদীগুলিতে এই ব্যাপারটা ঠিক যেন খোলতাই হয় না। ঠিক করলাম এবার একটু মেদিনীপুরের দিকে যাওয়া যাক। অন্য সব ব্যাপারেই – ঠিক আছে কাল পরশু করে নেব টাইপের ভাব থাকলেও একমাত্র বেড়ানোর ক্ষেত্রে আমার ভাবা মাত্রই কাজ। রাতের বেলাই ভেবে নেওয়া মানেই সকাল বেলা কাঁধে ঝোলা। পেশার কল্যানে চারিদিকে পরিচিত। তাদের কাছ থেকেই জেনে নিলাম মেদিনীপুরে এলে আমার জন্য যথার্থ স্থান হচ্ছে পাথরা।
সেই মত যাত্রা শুরু। সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ সাঁতরাগাছি থেকে চেপে বসলাম রূপসীবাংলা এক্সপ্রেসে। (একটু পরে আটটা নাগাদ আরন্যকও আছে সেটাতেও যাওয়া যায়। আর যাওয়া যায় লোকাল ট্রেনে, কিন্তু তাতে সময় লাগে অনেক বেশি। বাসও যায়, পছন্দ হলে তাতেও যেতে পারেন)। পৌনে নটা নাগাদ মেদিনীপুরে নামিয়ে দিল রূপসীবাংলা। স্টেশনেই ছিল আমার প্রাক্তন সহকর্মী তথা একটি ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক কৌশিক দত্ত। কৌশিককে না করেছিলাম, কিন্তু সে বারন যে সে শোনেনি ট্রেনে ওঠার পর ফোন পেতেই বুঝলাম। যাই হোক স্টেশন থেকে বেরিয়ে জলযোগ সেরে এবার আমাদের গন্তব্য মন্দিরময় পাথরা। মন্দির শুনেই ভাবছেন এত দূর থেকে বুঝি পুজো দিতে এলাম। আজ্ঞে না পাথরা না গেলে বোঝার উপায় নেই তার সৌন্দর্যের ভাণ্ডারখানি কতটা। যাই হোক স্টেশন থেকে অটো বা টোটো ভাড়া করে মোড়। সেখান থেকে অটো যায় পাথরা। সেই অটোতেই চেপে বসলাম আমরা। রাস্তা প্রথম দিকে বেশ ভালই ছিল, কিন্তু হাতিহলকা থেকে পাথরা এই দুকিলোমিটার রাস্তার কথা কহতব্য নয়।
ভাঙাচোরা রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে কাঁসাইয়ের বাঁধের উপর দিয়ে, একসময় পৌঁছে গেলাম পাথরা। আচমকা গাছপালার জঙ্গল সরিয়ে জেগে উঠল মন্দিরের সারি। রাস্তা থেকে অনেকটাই নিচে ছড়ানো ছিটানো মন্দির। কাঁসাইয়ের বাঁধ তৈরির জন্যই হয়ত রাস্তাটা অনেকটাই উঁচু হয়ে গেছে। আর মন্দিরগুলো নেমে গেছে নিচে। সামান্য দূরে বয়ে চলেছে কংসাবতী নদী বা কাঁসাই। একটা মন্দির আবার বাঁধ থেকে দূরে নিচু ক্ষেতের মধ্যে কাঁসাইয়ের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে। সব মিলিয়ে প্রথম দেখাতেই যেন প্রেমে পড়ে গেলাম। নির্জন, সবুজে ঘেরা ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা মন্দিরগুলি আপনারও মন কেড়ে নেবে এ আমি নিশ্চিৎ।
মন্দির, নাট মন্দির, কাছারিবাড়ি, রাসমঞ্চ, ঠাকুরদালান কি নেই। পাশেই পাথরা গ্রাম। গ্রামের বাড়ি, পুকুর, ধানক্ষেত, আলুর ক্ষেত, সবজীর ক্ষেত, বাঁশঝাড় সবকিছুর মধ্যেই ছড়িয়ে এই মন্দির এবং প্রত্নতত্ব নিদর্শন। ইতিহাস ও কিংবদন্তী এখানে মিলেমিশে আছে। শোনা যায় ১৭৩২ সাল নাগাদ বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব নআলীবর্দি খাঁ জনৈক বিদ্যানন্দ ঘোষালকে রত্নচক পরগনায় খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে তহশিলদার নিয়োগ ব্যক্তি তিনি ক্রমেই বিশাল ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে ফুলেফেঁপে উঠতে লাগলেন। পরে তিনি নবাব আলীবর্দির বিষনজরেও পড়েন। বিদ্যানন্দ ও তাঁর উত্তরসূরীরা একের পর এক মন্দির বানিয়েছিলেন পাথরায়, যা কালক্রমে পড়েছে ধ্বংসের মুখে। মন্দিরের ভেতর থেকে মূর্তি লোপাট করেছে চোরেরা। মাত্র ৮টি বাদে বাকি মন্দিরগুলিতে কেউ আর পুজো দিতেও আসে না। এখন মাত্র ৩৪টি মন্দির টিকে আছে।
পাথরায় এসে যার নামটি না জানলেই নয়, তিনি ইয়াসিন পাঠান। পাশ্ববর্তী গ্রাম হাতিহলকায় সাধারণ পরিবারের সন্তান ইয়াসিন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে স্থানীয় লোকজনকে সচেতন করে শুরু হয় তাঁর মন্দির বাঁচানোর লড়াই। বার বার প্রশাসনের কাছে ধর্না দিয়েছেন। রাজ্য ও কেন্দ্রের কাছে বহুবার দরবার করেছেন। প্রথমদিকে স্থানীয় মানুষজন তাঁর এই প্রচেষ্টাকে ভাল ভাবে না নিলেও পরে সহমত হয়েছে।
ইয়াসিন মানুষকে বোঝাতে শুরু করলেন এ গুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব। বোঝালেন মন্দির সংস্কার করে এই গ্রামকে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনা যাবে। নিমরাজি গ্রামবাসীরা প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে ক্রমে পাশে দাঁড়ালেন। প্রথমে শুরু হল মন্দির ঘিরে গজিয়ে ওঠা বনজঙ্গল সাফ করার কাজ। ১৯৯০ সালে ইয়াসিন তৈরি করলেন এন.জি.ও, পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ সমিতি। সদস্য হিন্দু মুসলমান এবং আদিবাসী নির্বিশেষে সারা গাঁয়ের মানুষ। উদ্দেশ্য মন্দির রক্ষনাবেক্ষনের প্রয়াস অব্যাহত রাখা। হাই স্কুলে সামান্য পিওনের চাকরি ইয়াসিনের। তবু অদম্য উৎসাহে পকেটের কড়ি খরচা করে কলকাতা দিল্লী করেছেন। সরকারী অফিসে দফতরে দরবার করেছেন। লিফলেট ছাপিয়েছেন। পুস্তিকা ছাপিয়েছেন। পাথরার মন্দির নিয়ে গবেষণামূলক বই অব্দি লিখেছেন, ছেপেছেন। আদিতে ১০০ পাতার গ্রন্থ এখন ৩৫০ পাতার সংকলন। অবিভক্ত মেদিনীপুরের ১০৬১ টি মন্দির, মসজিদ, গির্জা, কেল্লা বা প্রাসাদের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। নিঃস্ব হয়ে। কপর্দকশূন্য হয়ে।
সে ১৯৯৮ সালের কথা। প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ার পার্সন তখন প্রনব মুখোপাধ্যায়। প্রথম সরকারী অনুদান এল কুড়ি লক্ষ টাকা। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ.এস.আই অধিগ্রহণ করল মন্দিরগুলি। ২৮ টি মন্দির পুনর্নিমান করা হয়েছে। অনন্য টেরাকোটার কাজ ও বাংলা ঘরানার গঠনশৈলী সম্পন্ন মন্দিরগুলি, যাতে ইসলামি স্থাপত্যেরও ছোঁয়া। ইয়াসিন পাঠান তার কাজের জন্য কবীর পুরষ্কার পেয়েছেন। স্থানীয় একটি স্কুলে পিওনের কাজ করে সেই টাকা দিয়েছেন মন্দিরের সংরক্ষণের প্রচেষ্টায়। অবসর গ্রহণের কিডনির অসুখে তিনি কাতর ও সর্বস্বান্ত। তাঁর অসুস্থতার কারনে বাইরে যেতে হওয়ায় এযাত্রায় তাঁর সঙ্গে দেখা হল না আমার। এমন একজন মানুষের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় এত পাওয়ার মাঝেও ছোট্ট একটু আপসোস রয়ে গেল।
যার জন্য এখানে আসার সূচনা এবার সেই কাশফুল দর্শনের পালা। সেই সঙ্গে উপরী পাওনা কংসাবতী। বর্ষার পরে কাঁসাইয়ের এখন ভরা যৌবন। নদীর তীরে নানা ধরণের সবজি এবং ফুলের চাষ হয়েছে। আমাদের এখানে লঙ্কার এত দাম হলেও ওখানে শুনলাম ২ টাকা কেজি দরে বিকোচ্ছে লঙ্কা। কৃষকদের অনুরোধেই বেশ কিছু কাঁচা লঙ্কা ছেঁড়া হল গাছ থেকে। কলকাতা থেকে ওদের গ্রাম দেখতেই এসেছি শুনে কিছুতেই দাম নিলেন না ওরা। নদীর পাড় বরাবর কাশের মেলা। তাদের শ্বেতশুভ্র প্রতিবিম্ব পড়েছে কাঁসাইয়ের জলে। শহুরে জীবন থেকে বেরিয়ে এমন দৃশ্য যেন ভাললাগায় মুড়ে দেয় চারপাশটাকে।
কখন যে দেড়টা বেজে গেছে খেয়ালই করিনি, সম্বিৎ ফিরল কৌশিকের ডাকে। এবার ফেরার পালা। ছড়িয়ে থাকা মন্দিরগুলির দিকে ফের একবার চোখ বুলিয়ে রওনা দিলাম মেদিনীপুরের দিকে। শহরে এসে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে এবার আবার অটোয়। গন্তব্য গোপগড়। যতটুকু জানা গেল গোপগড় স্থানীয় গোপরাজাদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। গিয়ে জানলাম এখানে নাকি মহাভারতের বিরাট রাজার রাজপ্রাসাদও ছিল। সে পুরাণ বা ইতিহাস যাই হোক জায়গাটা কিন্তু খাসা। সবুজে মোড়া কয়েক একর জায়গা। ভূপৃষ্ঠ থেকে সামান্য উপরে। ছুটি ছাটার দিন ছাড়া খুব একটা ভিড় হয় না। শীতকালে অবশ্য অনেকেই পিকনিক করতে আসেন।
বনদফতর এখানে একটা প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। ভিতরে থাকার ব্যবস্থাও আছে। গোটা এলাকা দুটি ভাগে ভাগ করা। গাড়ি নিয়েও ঢোকা যায় এখানে। এক ভাগে শুধুই গাছপালা তার মাঝে কোথাও লাল মাটির কোথাও বা পিচ ঢালা পথ। নিজের সঙ্গেই হোক বা পছন্দের মানুষটিকে নিয়ে, এ পথে হাঁটতে ভাল লাগবেই। আমরাও এলোমেলো খানিক হেঁটে বেড়ালাম। এবার এলাম অন্যপাশে যেখানে মূল পার্ক এবং বিরাট রাজার প্রাসাদের সামাণ্য অবশিষ্টাংশ রয়েছে সেই দিকে। এদিকে কিন্তু গাড়ি বা বাইকের ঢোকা নিষেধ। হেঁটেই ঢুকতে হয়। তবে ওই যে বললাম এ পথে হাঁটতেও দারুণ লাগে। যারা হাঁটাহাঁটি পছন্দ করেন তাদের জন্য গোপগড় আদর্শ জায়গা। সবুজের মাঝে পিচের রাস্তা, সঙ্গী পাখ পাখালির কুজন।
এপাশটা বেশ সাজানো গোছানো। তবে প্রাসাদ বলে যেটি রয়েছে তার ভিতরে ঢোকা বিপদজনক। বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকলেও তা ভেঙে ঢুকেছেন অনেকেই, কিন্তু ভিতরে অপরিস্কার থাকায় সাপখোপের ভয় অতিমাত্রায়। এ চত্বরে বসার চমৎকার ব্যবস্থা। একটা ছোট্ট মত অডিটরিয়ামও আছে দেখলাম। চড়ুইভাতির পক্ষে অনবদ্য জায়গা বলে মনে হল। ভালই লাগছিল কিন্তু ফিরতে হবে যে। বেরলাম উল্টোদিক দিয়ে, কৌশিকই বলল যে ওপাশ দিয়ে গেলে নাকি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়টা দেখে নেওয়া যাবে। আমার কোনটাতেই না নেই। উল্টোদিকের রাস্তাটা আরও অদ্ভুত, আরও সুন্দর। এমনিতেই হাঁটতে আমার খুব ভাল লাগে, আমি তো গোপগড়ের অনুরাগী হয়ে গেলাম। সোনাঝুরি এবং কাজু গাছের বনের মধ্যে দিয়ে ওই পিচের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা গিয়ে বড় রাস্তায় উঠলাম। সেখান থেকেই পেলাম অটো, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটু উঁকিঝুঁকি মেরে এবার সোজা স্টেশন।
ছটা আটত্রিশে রূপসীবাংলা ঢোকার কথা, সে অবশ্য এল প্রায় আধ ঘন্টা দেরিতে। কৌশিককে বিদায় জানিয়ে চেপে পড়লাম ট্রেনে। সকালে উঠেই জায়গা পেয়েছিলাম, কিন্তু এখন কপাল অতটা সাথ দিল না। তবে খড়গপুর আসতেই মিলে গেল জায়গা। ব্যাগ থেকে পুজা বার্ষিকী বার করে ডুবে গেলাম তাতে। কেটে গেল ঘন্টা দুয়েক, মাঝে টুকটাক এটা ওটা খাওয়া। সব মিলিয়ে আমার মেদিনীপুর সফরটা কিন্তু রীতিমত জমে গেল। কৌশিককে বলা ‘ফের আসব’ কথাটা কিন্তু মাঝে মধ্যেই গুনগুনিয়ে উঠছিল মনের ভিতরে। সত্যি, ফের আসবই…