মহিলাদের বাজার

ইমা কেইথেল। মনিপুরি এই শব্দের বাংলা তরজমা করলে যার মানে দাঁড়ায় মায়ের বাজার। গোটা বাজার ঘুরে একজনও পুরুষ ব্যবসায়ীর দেখা মিলবে না এখানে। পুরুষরা এখানে শুধুই ক্রেতা। পাঁচ হাজারেরও বেশি মহিলা এই বাজারের ধমনী, শিরা-উপশিরা, সম্পূর্ণ চালিকাশক্তি। এই বাজারের ব্যবসায়ীদের গড় বার্ষিক আয় ৭৩ হাজার টাকা। এই বাজারের বার্ষিক টার্নওভার ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা।

সম্ভবত পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে পুরনো, মহিলা দোকানীদের বাজার এটি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়নি ঠিক কবে ইমা কেইথেলের বুৎপত্তি হয়েছিল। যদিও অনেকের ধারনা ১৬ শতকের আশেপাশে কোনও একটা সময়ে এই বাজার শুরু হয়।

অর্থনীতি সব রাজ্যেরই মেরুদণ্ড। মায়েদের এই বাজারে দেখা যায় মহিলা উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীদের। কেউ মাছ, কেউ সবজির পসরা সাজিয়ে বসেন। বাজার জুড়ে বাঁশ অথবা ধাতুর তৈরি হস্তশিল্প, শুকনো মাছ, ঐতিহ্যবাহী ফেনেকস বা সারঙের সারি। দেখা মেলে ইনেফিস বা দোপাট্টা, ছোট চাদর, আদিবাসীদের নানা প্রকৃতিক শেকড়-বাকর, ওযুধপত্র, চুরি, বালা কী নেই?

অন্তত চার হাজার মহিলা ব্যবসায়ী প্রতিদিন তাঁদের পসরা সাজিয়ে বাজারে বসেন। প্রথম দিকে এলোমেলো ছাউনিতে ছড়ানো ছেঁটানো বাজার ছিল। বর্তমানে খয়রামবান বাজার নামে গোটা বাজারটাই আরসিসি স্ট্র্যাকচারের একটা সীমাবদ্ধ জায়গায় বেঁধে ফেলা হয়েছে। ছড়ানো জায়গা থেকে যখন সীমাবদ্ধ গোছানো জায়গায় চলে এল, তখন অনেক ব্যবসায়ী তাদের বহুদিনের পুরনো জায়গা হারান। তবে ব্যবসা বন্ধ হয়নি কখনও। ওইর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন প্রত্যেকে।

ঐতিহ্যের দিক থেকেও মণিপুর মহিলা প্রধান। মহিলারাই অগ্রদূত। সে মদ, মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই হোক বা কঠোর আফস্পার বিরুদ্ধে আন্দোলন অথবা আর্থিক অসাম্য নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাই হোক-সব ক্ষেত্রে সামনের সারিতে সেই মহিলারাই। মহিলারা মণিপুরী সমাজে কোন ভূমিকা পালন করে ইমা কেইথেল তারই এক জলন্ত প্রমাণ। কোনও ধরনের সামাজিক সংকট দেখা দিলেও ইমা কেইথেলের মহিলারা এগিয়ে আসেন।নিজেদের মধ্যে মিটিং করেন। যিনি প্রধান পসারিনি, তিনিই পান নেত্রীর মর্যাদা। শুধুমাত্র কেইথেলের নেত্রী হয়েই থাকেন না, মণিপুরি মহিলাদের যে-কোনও সংগ্রামের নেত্রী হয়ে যান। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর ইম্ফলের মালোম শহরে অসম রাইফেল দশ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। মৃতদের মধ্যে বাষট্টি বছরের বৃদ্ধা ও আঠারো বছরের যুবতীও ছিল। সেই খবর পেয়ে ইরম শর্মিলা চানু প্রায় ৩০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে নিজের গ্রাম লেইকেই কংখাম থেকে কেইথেলে পৌঁছে যান। ইমাদের সঙ্গে কথা বলেন। সে দিন রাতে বাড়ি ফিরে নিজের মা’কে প্রণাম করে অনশনের অনুমতি নেন। সেই কাহিনী আজ ইতিহাস।

২০০৪ সালের ১০ জুলাই ইম্ফল শহরের কাছেই বামন কাম্পু মাধা লেইকাই গ্রামের মেয়ে থাউজাম মনোরমাকে অসম রাইফেল্সের ১৭ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কয়েক জন সৈন্য বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরের দিন মনোরমার বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ তাঁর বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি টিলার নীচে পাওয়া যায়। ওঁকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। সে দিন বিকেল থেকেই ইমা কেইথেলে মায়েরা জোট বাঁধেন। এক হাতে মশাল আর অন্য হাতে বস্ত্র তৈরির ‘তেম’ নিয়ে তাঁরা কয়েকশো জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানান। গোটা ইমা কেইথেল বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ জুলাই ইম্ফলের কাংলা দুর্গে অসম রাইফেলস-এর সদর দফতরের সামনে বারো জন মহিলা ঐতিহাসিক নগ্ন-বিক্ষোভ জানান। ওঁরা সকলেই ছিলেন ইমা কেইথেলের দীর্ঘ দিনের প্রাজ্ঞ পসারিণী। তাঁদের হাতে ছিল ব্যানার লেখা ‘ভারতীয় সেনা আমাদের ধর্ষণ করো, আমাদের হত্যা করো। আমরা প্রত্যেকে মনোরমার মা’। সে দিনের ইমাদের সেই বিক্ষোভ কর্মসূচি শুধুমাত্র মণিপুর কিংবা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তেই নয়, গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু মুক্ত বাজারের হাওয়ায় এখন পৃথিবীর অন্যতম বড় মহিলা-পরিচালিত বাজার বেশ চাপের মুখে। অনেকেরই আশঙ্কা, হয়তো-বা এক দিন ইমা কেইথেল থাকবেই না। এত দিন নিয়ম ছিল, কেইথেলের এক জন বয়স্কা ইমা অক্ষম হয়ে গেলে তাঁর মেয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে বসতেন। ইমাদের মূল পসারিনিদের বয়স হত চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ। এখন ইম্ফল শহরের মূল স্থায়ী কেইথেল পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পড়াশোনা-জানা কমবয়সি মেয়েরা ধারাবাহিক ভাবে আগের মতো ইমা হতে চাইছে না। পাশাপাশি কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ছোট-ছোট অস্থায়ী কেইথেলগুলো বড় হচ্ছে। তাতে অনেক ছোট-ছোট মেয়েকেই দেখা যাচ্ছে। গ্রামের মেয়েরা পড়াশোনার চেয়ে কেইথেলে গিয়ে বসাই লাভজনক মনে করছে।

আগে ইমারা নিজেদের হাতে তৈরি আচার, চাটনি, জেলি নিয়ে কেইথেলে আসতেন। এখন সে সব ইম্ফলের চোরাবাজারে পাওয়া যাচ্ছে।’ ইম্ফল থেকে মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে মোরে অঞ্চল। সেই অঞ্চল দিয়ে তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চিনের বহু পণ্যসামগ্রী চলে আসছে মণিপুরের বাজারে। দামও কম।

বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সবল হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া, ঘন-ঘন বনধ্‌, কারফিউ, পথ অবরোধ এ সবও দায়ী। ইমা কেইথেলেও জায়গা করে নিচ্ছে আমদানি করা পণ্যসামগ্রী। স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে কৌম সমাজের শিকড়টা ধরে রাখার চেষ্টাই দুর্বল হতে বসেছে। অনেকেই চিন্তিত যে কর্পোরেটাইজেশনের ঝোড়ো হাওয়ায় হারিয়ে যাবে কেইথেলের ঐতিহ্য? তার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাবে মণিপুরি মহিলাদের সংগ্রামের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 1 =