নির্জন দ্বীপে দাপাদাপি
পলাশ মুখোপাধ্যায়
##
নানান কাজের চাপে কাঁধে ঝুলি ফেলে দিকশূন্যপুরের উদ্দেশে বেরনো আর হয়ে উঠছিল না। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কদিন ধরেই হৃদয়ে যেন কুটনো কুটছিল। সেদিন সকালে উঠেই বিদ্রোহ করল মন, নাহ্, আর বিলম্ব নয়। আজই বেরতে হবে, না হলে বোধ হয় দম বন্ধ হয়ে আসবে। কিন্তু আশেপাশে তো প্রায় সবই ঘোরা কোন দিকে যাই। দিন কয়েক আগে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর কাছে শুনেছিলাম বলাগড়ের দিকে একটা নির্জন দ্বীপ আছে, সেই দ্বীপে কেউ থাকে না। ব্যাস এটুকুই আমার জন্যে যথেষ্ট। চিন্তা ভাবনার আর অবকাশ নেই এবার বেরিয়ে পড়ার পালা।
বলাগড় হুগলিতে। ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়ার দিকে যেতে কয়েকটা স্টেশন পরে বলাগড় স্টেশন। শিয়ালদা এবং হাওড়া দুদিক দিয়েই যাওয়া যায় ব্যান্ডেল পর্যন্ত। সেখান থেকে ফের কাটোয়া লোকাল ধরে মিনিট চল্লিশের পথ। সরাসরি কাটোয়ার ট্রেন ধরলে অবশ্য ব্যান্ডেলে পাল্টাতে হয় না। আমি অবশ্য নৈহাটি – ব্যান্ডেল হয়ে চলে এলাম বলাগড়। সকাল সকাল এলে শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকাল এবং জঙ্গিপুর প্যাসেঞ্জার ধরা যায়, এ দুটি ট্রেন এ পথ দিয়ে যায়। এখানেই বলে রাখি কলকাতা থেকে গাড়িতেও আসা যায় এ তল্লাটে। তবে ট্রেনে আসাটাই সুবিধাজনক। খুবই শান্ত নির্জন স্টেশন বলাগড়। স্টেশন লাগোয়া ছোট্ট বাজার, গুটিকয়েক দোকান।
পা বাড়ালাম পিচ রাস্তা ধরে, গুগল ম্যাপে মোটামুটি রাস্তাটা দেখে নিয়েছিলাম। শ্রীপুর বাজার থেকে ডান দিকে বেঁকে যেতে হবে। এখন এখানেও টোটো হয়েছে, টোটো চেপে যেতে পারেন শ্রীপুর, সেখান থেকে ট্রেকার ধরে নতুন ব্রিজ। রেস্ত থাকলে স্টেশন থেকে টোটো ভাড়া করে সরাসরিও যাওয়া যায় নতুন ব্রিজে। হেঁটে যেতেই পারেন তবে গুগল দেখাচ্ছে প্রায় সাত কিলোমিটার পথ। তাই যারা পদব্রজরসিক নন তাদের এ চেষ্টা না করাই ভাল। আমি অবশ্য হাঁটায় বিশ্বাসী হিউ এন সাং। তাই শান্ত ছায়াঘেরা পথ বেয়ে শুরু করলাম হাঁটা। শ্রীপুর বাজারটা কিন্তু বেশ জমজমাট। মোটামুটি মানের কয়েকটা হোটেল বা রেস্টুর্যাকন্টও রয়েছে এই তল্লাটে, দেখে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে পা বাড়ালাম।
শ্রীপুর ছাড়িয়ে মিনিট কুড়ি এগোতেই নজরে এল নতুন ব্রিজ। প্রথম চমক এখানেই। কংক্রিটের তৈরি আস্ত একটা পাকা সেতু। কিন্তু তাতে ওঠার কোন রাস্তা নেই। স্থানীয়রা মই বেয়ে ওই সেতুতে উঠছে। গৌরনগর দ্বীপের সঙ্গে সংযোগকারী সেতুটি কিন্তু রীতিমত চওড়া, বেশ ভাল। কিন্তু সরকারি পরিকল্পনার অভাবে এবং কিছু জটিলতার কারনে তা তৈরি হওয়া সত্বেও সেতু সংযোগকারী রাস্তা আর তৈরি হয়নি। স্থানীয় মানুষজন বাঁশ বাঁধা একটি মইয়ে চড়ে ব্রিজের উপরে ওঠেন। সেতুতে উঠে গেলে অবশ্য আর ঝামেলা নেই, ওপাশে দ্বীপের দিকে সেতু থেকে নামতে সমস্যা নেই। যারা এটা পড়ে ভাবছেন যাওয়া ঠিক হবে না, তাদের জন্য বলি এটাও কিন্তু বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের মত। তবে যারা মইয়ে চড়তে পারবেন না তারা নৌকো নিয়ে দ্বীপে যেতেই পারেন। অনেক নৌকো আছে। দ্বীপের একটা বড় অংশে এপারের মানুষ চাষাবাদ করেন। তাই তারা নৌকো নিয়ে যাতায়াত করেন।
আমি তো মইয়ে চেপে উঠে গেলাম ব্রিজের উপরে। যেহেতু গাড়ি ঘোড়ার চলাচল শুরু হয়নি পরিস্কার ব্রিজটির উপরে দাঁড়াতে ভাল লাগল বেশ খানিকক্ষণ। এবার আমার মূল গন্তব্যে প্রবেশের পালা। ব্রিজ পেরিয়ে দ্বীপে পা রাখতে নজরে এল দু একজনকে। কেউ গরু চরাতে এসেছেন আবার কেউ চাষ করতে। তাদের সঙ্গে কথা বলেই জানতে পারলাম বেশ বড় ঐ দ্বীপের পুব দিকে বড় একটা যান না কেউই। মাঝের দিকটাতেও চাষ তেমন হয় না। তাই দ্বীপের একটা বড় অংশই জনমানবহীন। নানা ধরনের সবজি, কলার চাষ হয়েছে গঙ্গার বুকে জন্মানো এই দ্বীপে। ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম নির্জন দ্বীপের ভিতরের দিকে। একটু এগোতেই বড় বড় ঘাস, মাঝে ছোট ছোট কুল গাছ। তার মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ। কিছুটা পথ চলার পর শুধু পাখির ডাক ছাড়া আর কোন শব্দই কানে এল না। কেমন যেন মনে হল নামিবিয়ার কুইভার ট্রি জঙ্গলে রয়েছি। কোন একটা ক্যালেন্ডারে নামিবিয়ার এই জঙ্গলের একটা ছবি দেখেছিলাম, তার সঙ্গে আমার দেখা সামনের ছবিটার ভীষণ মিল। আরও একটু ছুটে গিয়ে মনে হল এই দ্বীপে যেন আমি একা। এ যেন আমার একার দ্বীপ। খুব জোরে চিৎকার করে উঠলাম এ আ—-মা—র দ্বী—প। গাছে থাকা পাখিগুলো কলরব করে উড়ে গেল। তারপর ? ফের শান্ত সবুজ সেই দ্বীপ।
চেতনা ফিরল খানিক পরে। কেমন যেন একটু লজ্জাও লাগল নিজের ছেলেমানুষি দেখে। আসলে আশেপাশে কেউ না থাকলে আমরা বোধহয় এমন শিশুই হয়ে উঠি। জনমানবহীন নীরবতা আমাদের মধ্যে সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেমানুষিকে যেন ফিরিয়ে আনে। অনেকটা হেঁটে এসেছিলাম তো এবার কেমন যেন খিদে পেয়ে গেল। একটা গাছের ছায়ায় বসে ব্যাগ থেকে সঙ্গে থাকা কিছু বিস্কুট কেক বের করে পেট পুজো সারা গেল। এবার আরও একটু ঘুরে দেখার পালা। পুব দিকে এগোলাম। দ্বীপের মধ্যেই রয়েছে একটা জলাশয়। সেখানেও জলে শালুক ফুটে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। পূব দিকে গঙ্গার মূল অংশ। এখানে কাদার ভাগও কম। সাদা বালি। তাই জলেও নামা গেল একটু। পা ভিজিয়ে মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিতেই সব ক্লান্তি যেন উধাও। না, নির্জনতা কিন্তু আমার পিছু ছাড়েনি। ধারে কাছে কেউ নেই। গাছপালার অভাব নেই এই দ্বীপে। গুগল বলছে এই দ্বীপের নাম গৌরনগর দ্বীপ। কিন্তু স্থানীয়রা এই নামে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয় দেখলাম। কয়েক ঘন্টা দ্বীপে কাটিয়ে এবার ফেরার পালা। আমি অবশ্য এখান থেকে বলাগড় হয়ে একটু সুখারিয়া যাব বলে ঠিক করেছি।
যে পথে এসেছি সেই পথেই ফিরতে হবে। বলাগড় থেকে সোমরাবাজারের দিকে যেতে পড়ে সুখাড়িয়া গ্রাম। সেখানে আনন্দময়ী মন্দিরটি বড় সুন্দর। আমার দেবদ্বিজে খুব একটা ভক্তি আছে তা কেউ বলবে না, কিন্তু এই মন্দির চত্বরটি যে বড় সুন্দর সেটা আগেই শুনেছিলাম। তাই এবার আর হেঁটে নয়, শ্রীপুরে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে বলাগড় থেকে আর একটি ট্রেকারে চেপে রওনা দিলাম সুখাড়িয়ার দিকে।
হুগলির একটা ছোট্ট গ্রাম, কিন্তু স্থাপত্যের ইতিহাসের দিক থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় সুখাড়িয়া। টেরাকোটার তিনটে অপূর্ব মন্দির। এগুলির মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল ১৮১৩ সালে তৎকালীন জমিদার বীরেশ্বর মিত্রমুস্তৌফির তৈরি আনন্দময়ী মন্দির। জমিদারিবাড়ি পেরিয়ে মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরের সামনে সুপ্রশস্ত উঠোন, পাশে সারি সারি শিবমন্দির। মন্দিরের ঠিক পাশেই প্রশস্ত দিঘিতে কাজল কালো টলটলে জল। স্থাপত্যে ও ভাস্কর্যে অতুলনীয় আনন্দময়ী মন্দির বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই মন্দির বারো চালার। মন্দিরটির চাল তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। মোট ২৫টি শিখর। চার চালার প্রথম স্তরে ১২টি, দ্বিতীয় স্তরে ৮টি, তৃতীয় স্তরে ৪টি এবং মধ্যস্থলে বৃহত্তম রত্ন বা শিখর। মন্দিরের স্তম্ভ, খিলান, শীর্ষ ও বাইরের দেওয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণ। কাছেই নিস্তারিণী কালীর পশ্চিমদুয়ারি নবরত্ন মন্দির ও হরসুন্দরী কালিকা মন্দিরও রয়েছে। সেগুলিও কম সুন্দর নয়। সিনেমায় দেখা মন্দিরগুলির মতই সুন্দর লাগল আনন্দময়ী মন্দির চত্বর।
এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে জমিদার বাড়িটিও। কালের নিয়মেই সেই বৈভব বা জৌলুস আজ আর নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে সেই বনেদিয়ানা। আজও ভগ্নপ্রায় জমদার বাড়িটির আনাচে কানাচে সেই ফেলে আসা যাক জমকের অনুরণন শোনা যায়। অতিতের সঙ্গে খানিক সময় কাটাতে কিন্তু মন্দ লাগবে না।
এবার ফেরার পালা, আর বলাগড় নয়, কাছেই সোমরা বাজার স্টেশন। সেখান থেকেই ট্রেন ধরে নেব ঠিক করলাম। স্টেশনে পৌঁছতেই ঘোষণা শুনলাম শিয়ালদাগামী জঙ্গিপুর প্যাসেঞ্জার গুপ্তিপাড়া স্টেশন ছাড়বে। খুব শান্তি এবং স্বস্তি পেলাম, যাক একবারে দমদমে গিয়ে নামব। জঙ্গিপুর প্যাসেঞ্জার মোটেই ফাঁকা ছিল না, তবে মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে ব্যান্ডেলে এসে মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেল ট্রেন। জানালার ধারে একটা জায়গাও জুটে গেল। রাতের গঙ্গা পেরতে পেরতে ফের মনে পড়ে গেল ফেলে আসা সেই দ্বীপের কথা। আনমনেই হাসি খেলে গেল দ্বীপে দিনভর দাপাদাপি আর ছেলেমানুষির কথা ভেবে। কতক্ষন এমন ক্যাবলার মত হাসছিলাম জানি না, নৈহাটির হৈচৈ তে সম্বিত ফিরতেই দেখি আমার সামনের মানুষটি অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এবার তো গম্ভীর হওয়ার পালা… জানালার বাইরে চোখ রেখে চেয়ে রইলাম গম্ভীর মুখে, মনে কিন্তু তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দ্বীপে দেখা ছেলেমানুষিটা। ওকে নিয়েই তো ফের কয়েকটা দিন বেঁচে থাকা নাগরিক যন্ত্রণার মাঝে।
সুখাড়িয়ার ছবিগুলি শুভদীপ ঘোষের তোলা। এক বাক্যে তিনি এই ছবিগুলি দিতে রাজি হয়েছিলেন। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ তার কাছে।