লক্ষ্যে অবিচল লক্ষ্মী
পলাশ মুখোপাধ্যায়
ছোট থেকেই বিবেকানন্দের আদর্শকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন জীবনের সঙ্গে। যাদের জন্য অন্য কেউ নেই তাদের পাশে দাঁড়ানোর সঙ্কল্প করেছিলেন একরত্তি বয়স থেকেই। গীতার শ্লোক তাকে শক্তি যোগাত। তাই তো হাজার প্রতিবন্ধকতা স্বত্ত্বেও হার মানেননি সিঙ্গুরের লক্ষ্মী দাস পাত্র। মনের জোর আর প্রবল জেদ গ্রামের এক অতি সাধারণ মহিলাকে অসাধারণ করে তুলেছে। ১৯৭৪ সালে মির্জাপুর বাঁকিপুর এলাকার দক্ষিণ মামুদপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম। লড়াই ছোট থেকেই শুরু। স্থানীয় স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন মনের জোরেই। স্কুলেরই এক শিক্ষকের ছেলের সঙ্গে পড়তে পড়তে প্রেম। উচ্চমাধ্যমিকের পর নার্সিং এর ট্রেনিং এ যান। তার পরে চাকরি। এরই মধ্যে ২০০৪ সালে বিয়ে করে ফেলেন ভালবাসার মানুষটিকে।
ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর লক্ষ্মীর কাছে এর পরই আসতে থাকে একের পর এক ধাক্কা। বিয়েটা মেনে নেয়নি কোন পক্ষই। শ্বশুরবাড়ি তাকে ঘরে নিতে অস্বীকার করে। কয়েক মাস এক সঙ্গে থাকার পর স্বামী বাড়ির লোককে বোঝানোর অজুহাতে তাকে ফেলে চলে যায়। তার পর থেকে আর খোঁজও নেয়নি স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। কয়েকবার নিজেও গিয়ে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু অপদস্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ছেড়ে দিতে হয়েছে চাকরিটিও। ততদিনে তিনি মা হয়েছেন। কোলের ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসে সেখানেও জোটে লাঞ্ছনা। নিজের এত দুঃখের মধ্যেও কিন্তু অন্যের জন্য কিছু করবার ইচ্ছেটা সযত্নে পুষে রেখেছিলেন। স্থানীয় একটি আশ্রমের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলই, সেখানে গিয়ে আবাসিক শিশুদের নানা ভাবে সাহায্য করতেন। আশপাশের অন্যান্য অনাথ দুস্থ শিশুদের কষ্ট তাকে নাড়া দিত, চেষ্টা করতেন তাদের জন্য কিছু করা যায় কি না। সাধু লক্ষ্যে জুটে যায় সুযোগও। স্থানীয় একজন আশ্রম করবার জন্য জমি দিতে রাজি হন। ২০০৮ সালে সেই জমিতেই গড়ে ওঠে ছোট্ট চালাঘর। নিজের ছেলের সঙ্গে আরও চারটি শিশুকে নিয়ে শুরু হয় পথ চলা। ভালই চলছিল, কিন্তু লক্ষ্মীর তো সুখের সঙ্গে আড়ি। হঠাৎই বিগড়ে বসেন সেই জমিদাতা, খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করেন। উঠে যেতে বলেন। ততদিনে ওই চালা ঘরের পাশে পাকা ঘর করবার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন লক্ষ্মীরা। চাকরি করাকালীন জমানো সামান্য কিছু টাকা এবং নিজের গহনা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন বাড়ির কাজ। কিন্তু জমিদাতার বাধায় সেই কাজ গেল থমকে। বহু কষ্টে জোগাড় করা প্রায় এক লক্ষ টাকা জলে। লক্ষ্মীর কাছে এও এক বিরাট ধাক্কা।
কিন্তু থেমে যেতে শেখেননি লক্ষ্মী। বাবার পড়ে থাকা গোয়ালঘরের জমিতে ফের কোনও রকমে বাঁশ ত্রিপল দিয়ে একটা আচ্ছাদন গড়ে ছেলেমেয়েগুলিকে আশ্রয় দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। আশ্রমের নাম দিলেন সবুজানন্দ মিশন। সে তো হল, কিন্তু টাকা কোথায়? ততদিনে সংখ্যা বেড়েছে আবাসিকদেরও। তাদের খাবার জোগাড় করা, দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হত না লক্ষ্মীর। এর সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে যোগ হল পাড়া প্রতিবেশীদের অসহযোগিতা এবং অত্যাচার। নানা অপবাদ, মাঝে সাঝে আক্রমণ, ছেলেধরা বলে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া কিছুই বাদ রাখেননি প্রতিবেশীরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলির মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য ট্রেনে উঠে ভিক্ষেও করতে হয়েছে লক্ষ্মীকে। তবে সকলেই খারাপ নন, এর মাঝেই কয়েকজন সাহায্য করতেন লক্ষ্মীকে। এর মধ্যে পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয়, লক্ষ্মীর বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছে সিঙ্গুর থানা। সক্রিয় ভাবে এই আশ্রম চালাতে সাহায্য করেছেন পুলিশ আধিকারিকেরা। ছোট্ট চালাঘরটির দুর্দশা দেখে সেই সময় সিঙ্গুর থানার বড়বাবু অমিত মিত্র নিজে উদ্যোগী হয়ে অর্থ সাহায্য করেন। তার উদ্যোগেই ২০১৫ সালে পাকা বাড়ি পায় সবুজানন্দ মিশন।
লক্ষ্মীর লড়াই কিন্তু এখনও জারি, আগের সেই জমি নিয়ে আইনি বিবাদ চলছে। এখন যেখানে আছেন সেখানেও খুব একটা শান্তিতে নেই তিনি। বাপের বাড়ির জমি মাঝেমধ্যেই সেটা জানিয়ে দেন ভাইয়েরা। নিজের খাওয়া পরা নিয়ে কখনও ভাবেননি। কিন্তু কচিমুখগুলোর খিদে মুখ যে সহ্য করা যায় না। দরকার সাহায্য, নিশ্চিত রোজগার। তাই তো এখনও যা পারেন যেমন পারেন কাজ কর্ম করবার চেষ্টা করেন। তারই মাঝে রেল লাইনের ধার বা ফুটপাথ অসহায় একাকী শিশুকে দেখলেই নিয়ে আসেন সঙ্গে। ১৪ জন আবাসিক থাকে এই আশ্রমে। তাদের পড়াশোনা, গান বা আঁকা শেখার ব্যবস্থাও করেছেন লক্ষ্মী। সকলে যাতে মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যেই নিয়োজিত করেছেন নিজেকে। শুধু মুখের হাসি আর মনের বলকে সম্বল করে ছোট ছোট এই ছেলেমেয়েদের নিয়েই ভরা সংসার লক্ষী দাস পাত্রের। একটু সাহায্য পেলে আরও একটু বাড় বাড়ন্ত হতে পারে লক্ষ্মীর সংসার।
আমরা কি পারি না একটু এগিয়ে পাশে দাঁড়াতে প্রচারের আড়ালে নিরবে কাজ করে যাওয়া এই মহান নারীর? কিছু না হোক একটা কুর্নিশ তো প্রাপ্য অজপাড়াগাঁয়ে শত প্রতিকুলতাকে সঙ্গী করে পরের স্বার্থে ক্রমাগত লড়ে যাওয়া এই অ-সাধারণ মেয়ের। কি বলেন?