মহিষরেখা, হয়েছে কি দেখা ?
পলাশ মুখোপাধ্যায়
##
‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া…’ বিশ্বকবির মত এত ভালো করে আমাদের কেই বা চেনে। তাই তো এত সহজে, এত স্পষ্টভাবে আমাদের মন বা মননের কথা প্রকাশ করেছেন তিনি। কবিগুরুর সেই ক্ষেদ বা আফসোস যাদের মধ্যে আজও চারিত তারাই তো ঘুরণচণ্ডী। এবারের ঘুরণচণ্ডীর ডায়েরীতে আমরা একটু দক্ষিণমুখী। সকাল সকাল হাওড়া থেকে চেপে বসলাম ট্রেনে। গন্তব্য বাগনান। কি, এটুকু শুনেই মনে হল তো, বাগনান – সে তো জানা এলাকা। অমুকের পিসির বাড়ি, বা তমুকের মামার বাড়ি। তাহলে বলি আরও একবার তাহলে চেনা বাগনানেই চলুন। দাবি করছি সে সফর অচেনা লাগবেই।
হাওড়া দক্ষিণ শাখার ট্রেনে চেপে মজা আছে। বেশ ফাঁকা ফাঁকা ট্রেন, তেমন ভিড়ভাট্টা হয় না। নানা রকমের খাবার দাবারও মেলে। সেই সব মুখরোচক খাবারে মুখ চালাতে চালাতে ঘন্টা পেরনোর আগেই হাজির বাগনান। ষ্টেশনে নেমে এবার উত্তর দিকে (হাওড়ার দিকে) হাঁটা শুরু। খানিক গেলেই পড়বে রেলগেট। এখন অবশ্য গেটের ওপরে উড়ালপুল হয়েছে। যাই হোক পুলের তলা দিয়ে রেললাইনের গা ঘেঁসে ছোট্ট পায়ে চলে পথে নেমে চলুন। খানিক গিয়ে একটা ছোট পাড়া মিলবে। সেই পাড়ার ভিতর দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর লোকালয় শেষ। এবার আপনার রাজত্ব শুরু। এক পাশে রেললাইন, অন্য পাশে ধুধু মাঠ। মধ্যে দিয়ে মাটির সেই পথ। পথের দুপাশে খেজুর গাছের সারি। হালকা শীত হোক বা গরম কাল যে কোন সময় এই পথ অসাধারণ।
খোলা গলায় উচ্চস্বরে গান বা মুক্ত আকাশের নিচে একটু ডিগবাজি। না, দেখবার কেউ নেই। তাই এ পথের মজাই আলাদা। যাচ্ছি কোথায়? ওমা, দেখেছেন সেটাই তো এখনও বলা হয়নি। আমাদের আসল গন্তব্য মহিষরেখা। দামোদরের পাড়ে এক নির্জন সহজ সুন্দর এলাকা। যাই হোক মাঠের মাঝে এই পথ ধরে হাঁটতে হবে বেশ খানিকক্ষণ। নির্জনে নিজের সঙ্গে হাঁটা বা সঙ্গিনীর হাত ধরে চলা। পথ দেখবেন কখন শেষ হয়ে গেল টেরটুকুও পাবেন না। হঠাৎ সামনে হাজির দামোদর।
কাজল কালো জলে দুষ্টুমির আভাষ। একধারে সবুজ ঘাস, অন্য দিকে ফুলের বাগান। না সাজানো গোছানো বাগান নয়। এ অঞ্চল জুড়ে ফুল চাষ হয়। সেই রঙ বেরঙের ফুলের ক্ষেতের মাঝে দাঁড়ালে বেশ একটা রোমান্টিক ভাব আসবেই মনে। নদীর ধার বরাবর দীর্ঘ সে ফুলের বাগান। শীত কালে সেই সৌন্দর্য আরও খোলতাই হয়। দুদণ্ড বসতেই পারেন নদীর ধারে ফুলের ক্ষেতের মাঝে, হলফ করে বলে পারি মন্দ তো লাগবেই না, বরং ফিরে আসতে নাও ইচ্ছে হতে পারে। নদীর ধার বরাবর ফুলের বাগানের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে মাটির পথ। সেই পথ গিয়েছে দূরে কোন গ্রামে। দুপাশে গাছগাছালি ছাওয়া সেই মায়াবী পথের আকর্ষণ বড় কম নয়। শীতের নরম বেলায়, রৌদ্র-ছায়া মাখা সেই পথে এলোমেলো ঘোরাঘুরি চলুক খানিক সময়।
বেলা একটু পড়ে এলে এবার নদীর ধারের মাঠে সবুজ ঘাসের মাঝে বসা যাক খানিকক্ষণ। সঙ্গের ঝুলিতে যদি টুকটাক মুখ চালাবার মত কিছু থাকে তাহলে তো কথাই নেই। বলে রাখা ভাল, এ তল্লাটে কিন্তু কোন খাবার দাবারের দোকান পাবেন না। ফলে যা কিছু নিয়ে আসতে হবে, তা বাগনান থেকেই।
এবার নদীর ওপারে যাওয়ার পালা। তিন রকম ভাবে যাওয়া যায় নদীর ওপারে। কাছে থাকা নৌকার মাঝিভাইকে অনুরোধ করলে সে ওপারে নামিয়ে দিতে পারে। অবশ্য এই সুযোগে খানিকটা নৌবিহারও করে নিতে পারেন। দরদাম করে পোষালে নৌকা চড়ে দামোদরের বুকে ঘন্টা খানেক সময়ও কাটানো যেতেই পারে।
এছাড়া আছে রেল সেতু। সেতু পেরিয়ে ওপারে যাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষজন যান বটে, কিন্তু এপথ বেশ বিপজ্জনক। কারন ঘনঘন ট্রেন আসে এই লাইনে। রেলসেতু পারাপার তাই নিরাপদ নয়। বেশ কিছুটা দূরেই আছে আরো একটি সেতু। ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপরে। সেই সেতু পেরিয়ে চলে আসা যাবে নদীর এপারটায়। এপারে অবশ্য শীতকালে চড়ুইভাতির ভিড় থাকে। জনসমাগম এড়াতে চাইলে আরো একটু দূরে চলে যেতে পারেন।
ফেরার সময় একই পথে ফেরা যেতে পারে। সন্ধের আবছা আলোয়, হালকা শীতের আমেজ গায়ে মেখে হাঁটতে মন্দ লাগবে না। তবে সারাদিন ঘোরাঘুরিতে যদি ক্লান্ত মনে হয় তবে ফেরার অন্য রাস্তাও আছে। ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে বাগনান যাওয়ার অটোরিকশা বা বাস পাওয়া যায়। বাস মেলে সরাসরী হাওড়া বা কলকাতায় আসারও। এই ভাবে মহিষরেখায় আসাও যায়, কিন্তু সেই মজাটা মিলবে না। তাই আমি কিন্তু ট্রেনে আসারই পক্ষপাতী।
যাইহোক এতক্ষণে তো নিশ্চয় পেটে আন্দোলন-কলরব শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই বাগনানে পৌঁছে ভালোমন্দ কিছু উদরস্থ করা নেওয়াই ভাল। রোল-চাউমিন থেকে শুরু করে বিরিয়ানি-তন্দুর , মিলবে সবই। তবে আমার কথা যদি শোনেন তবে বলব গবার চপ বা বামাচরণের মিষ্টির কথা। অন্যান্য খাবার তো যে কোন জায়গাতে পেতেই পারেন। কিন্তু বাগনানে এলে গবার চপ না খাওয়াটা ঠিক হবে না। আর চপের পরে একটু মিষ্টিমুখ না করলেই নয়, তাই বামাচরণ তো রয়েইছে। দুটো দোকানই ষ্টেশনের খুব কাছে, তাই খাওয়া দাওয়া সেরে এবার ধীরেসুস্থে হাওড়াগামী যে কোন ফাঁকা ট্রেন দেখে উঠে পড়লেই,… ব্যাস।