সংস্কৃতই সংস্কৃতি

আমাদের আদি ভাষা সংস্কৃত হলেও স্কুলে নিচু ক্লাসে নম্বর তুলতে সংস্কৃত নেওয়া বা পুজোর মন্ত্র বলা, এ পর্যন্তই সংস্কৃত চর্চা সীমিত। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের শিমোগা জেলার মাত্তুর গ্রামের নাম তাই আমাদের তেমন শোনা নেই। তুঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রাম ভারতের অন্য সব গ্রাম অথবা শহরের চেয়ে আলাদা। কারণ এখানে সকলেই কথা বলেন সংষ্কৃত ভাষায়। শুধু কথা বলাই নয়, গ্রামের লোকেরা সদাসতর্ক যাতে গ্রামের সকলে এই ভাষার চর্চা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কবে ও কি ভাবে শুরু হল এই মাত্তুর গ্রামে সংষ্কৃতের চর্চা? অনেকের মতে ১৯৮১ সালে ‘সংষ্কৃত ভারতী’ নামে এক সংস্থা সংষ্কৃত ভাষার প্রচারে আসে এই গ্রামে। গ্রামের প্রচুর মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করেন। ব্যস, তখন থেকেই পথ চলা শুরু। ওই সংস্থা নিজেদের প্রচার সেরে চলে গেলেও সংষ্কৃত ভাষা ও বৈদিক জীবনযাত্রাকে আপন করে নেন মাত্তুর গ্রামের মানুষ।

প্রত্যেকের বাড়িতে শুরু হয় সংষ্কৃতের চর্চা। এখনও প্রত্যেকে বাড়িতে সংষ্কৃত ভাষাতেই নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। অর্থাৎ মাত্তুর গ্রামের মূল ভাষাই হল সংষ্কৃত। আর এই ভাষাকে জোর করে নয়, ভালোবেসে আপন করেছেন এখানকার মানুষ। সাধারণ কথাবার্তা থেকে শুরু করে বাড়ির পোষ্য কুকুর-বিড়ালকে ডাকা, খেতে দেওয়া সব কিছুতেই ব্যবহার করা হয় দেবভাষা। সকলে বোঝেও সেটা। এ গ্রামের কৃষকরা গরু, মহিষকেও নির্দেশ দেন সংস্কৃতে। এর পাশাপাশি গ্রামের ইতিহাসও কিন্তু সংস্কৃত চর্চার পক্ষেই কথা বলে।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সেই উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’| দুই নদী মিলে তুঙ্গভদ্রা| তার এক নদী তুঙ্গ| বিজয়নগর সাম্রাজ্যে সেই নদীর তীরে এসে প্রায় ৬০০ বছর পূর্বে বসত গড়েছিলেন সাঙ্কেথি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়| যজন যাজনের জন্য জায়গাটিকে উপযুক্ত মনে হয়েছিল তাঁদের|

 

এই সম্প্রদায়ের আর একটি গোষ্ঠী একটু এগিয়ে বসত গড়েছিল হোসাল্লিতে| দুটি গোষ্ঠীই সম্রাটের দেওয়া জমি ও অন্যান্য সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছিলেন ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়ে| শেষে এক ব্রাহ্মণের হাত দিয়ে তাঁদের জমি দান করেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজা| মূলত কেরল থেকে আসা এই ব্রাহ্মণদের বংশধররা এখনও আছেন| তাঁরা সংস্কৃত ভাষার চর্চার ধারক ও বাহক| তবে কালক্রমে তাঁদের কথ্য ভাষাতে মিশে গেছে কন্নড়‚ তেলুগু‚ তামিল| তবে মূল ব্যাকরণ কিন্তু অনুসরণ করা হয় দেবভাষারই এবং হরফ অবশ্যই দেবনাগরী|

মাঝে সংস্কৃত চর্চায় ভাটা পড়েছিল| ফের স্থানীয় মঠের প্রধানের উদ্যোগে শুরু হয়েছে চর্চা| এবং সেই ধারা আজও চলেছে| শুধু ব্রাহ্মণ নয়| গ্রামের সব সম্প্রদায়ের সব পেশার মানুষ ঝরঝরে সংস্কৃত বলেন| বাদ যান না মুসলিমরাও| তাঁরাও আপন করে নিয়েছেন দেবভাষাকে| এই গ্রামটি একটি বর্গক্ষেত্রের আকারের। গ্রামের মাঝে রয়েছে একটি মন্দির ও পাঠশালা। সেখানেই আদি রীতি মেনে বেদের পাঠ দেওয়া হয়। এখন বিদেশ থেকেও বহু মানুষ এসে এই গ্রামে থেকে সংষ্কৃতের পাঠ নিচ্ছেন। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে থাকে ইংরেজি বা কন্নড়। তার মানে কিন্তু এই নয়‚ সবাই বড় হয়ে পুরোহিত হয়। গ্রামের নতুন প্রজন্ম তথ্য প্রযুক্তি জগতেও সমান স্বচ্ছন্দ এবং তারা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করেছে‚ সংস্কৃত পড়ায় তাদের সুবিধে হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষা আয়ত্ত করতে।

এই গ্রামে মূলত ধান ও বাদামের চাষ হয়। মাত্তুর গ্রামে গেলে দেখা যাবে, দোকান-বাজার থেকে শুরু করে সর্বত্র সকলে অনর্গল সংষ্কৃত বলে যাচ্ছেন। নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা মিলবে পাড়ে বসে বয়স্করা বেদের মন্ত্র পড়ছেন। মাঠে খেলার সময়ে ছোট ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে সংষ্কৃতে কথা বলছে। দেওয়ালে কোনও কিছু লেখা থাকলে সেটাও লেখা সংষ্কৃতেই। এমনভাবেই পুরনো সংষ্কৃতিকে সঙ্গী করেই খুশিতে জীবন কাটছে মাত্তুরের গ্রামবাসীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 + 3 =