নাটকের শহরে নাট্যোৎসব
পলাশ মুখোপাধ্যায়
নাটকের আছে নিজস্ব ভাষা। যে ভাষার কোন দেশ কাল বা জাতিভেদের বেড়া নেই। নাট্যমোদী মানুষ বুঁদ হয়ে যান সেই নাটকের নিজস্ব ভাষাতেই। এই চিরন্তন সত্যিটাই ফের একবার স্পষ্ট হল গোবরডাঙ্গায় দ্বিতীয় জাতীয় নাট্যোৎসবে। গোবরডাঙ্গা নাটকের শহর। তার নাট্যচর্চার ইতিহাস এবং ধারাবাহিকতা দেখলে এ সত্য অস্বীকার করতে পারবেন না অতি বড় নাট্যরসিক বা বেরসিকেরাও। গোবরডাঙ্গার নাট্যচর্চার মুকুটে অন্যতম উজ্জ্বল এবং রঙিন পালকের নাম ‘গোবরডাঙ্গা নকসা’। দীর্ঘদিন ধরে নাট্যচর্চায় ব্রতী নকসা এখন শুধু এই মফস্বল শহরেই নয় রাজ্য ছাড়িয়ে দেশেও পরিচিত নাম। তাদেরই উদ্যোগে বসেছিল দ্বিতীয় নাট্যোৎসবের আসর। সহযোগিতায় গোবরডাঙ্গা পুরসভা।
ছ’দিন ব্যাপি এই উৎসবে ১১ টি নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছেন স্থানীয় নাট্যপ্রিয় মানুষজন। রাজধানী দিল্লীর পাশাপাশি অসম, ওড়িশা, জম্মু থেকে আসা নাট্যদলের প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে নাট্যোৎসবের আঙিনায়। দিল্লীর ইউনিকর্ন অ্যাক্টরস্ স্টুডিও প্রযোজিত ‘রূপ অরূপ’ , ওড়িশার নাট্য চেতনা প্রযোজিত ‘ধোঁয়া’, অসমের সিগাল থিয়েটারের ‘ফাইভ টোন অফ লাভ’ , জম্মুর রঙ্গলোক থিয়েটারের ‘জিরো’, বা অসমেরই বাডুংডুপ্পা গোষ্ঠীর ‘রিদম্ অফ ভ্যালি’। সব কটি নাটকই ছিল তাদের নিজস্বতায় উজ্জ্বল। অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে, মনোযোগ সহকারে নাটকগুলির স্বাদগ্রহণ করেছেন গোবরডাঙ্গাবাসী। না, ভাষা কোন ব্যাঘাত ঘটায়নি ভিন রাজ্যের এই নাটকের রসাস্বাদনে।
আসলে গোবরডাঙ্গার মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে নাটক দেখতে অভ্যস্ত। নাটকটা তারা ভালোবেসেই দেখেন, বোঝেন, মতামতও দেন। তাই তো যখন এই মঞ্চেই ভারত ইতালির যৌথ প্রযোজনায় ‘ইফিগেনিয়া মিটস্ ইলেক্ট্রা’ অভিনিত হয় তখনও মন্ত্রমুগ্ধের মত তার সবটুকু চেটেপুটে নেন দর্শকেরা। এই প্রযোজনার কুশিলবরা ছিলেন ইতালি, জার্মানি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের মানুষ। তাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রুচির মধ্যে বৈচিত্র থাকলেও এই প্রযোজনায় তারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। নাটকের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন দর্শকেরাও। তাই তো গোবরডাঙ্গার মত একটি অখ্যাত মফস্বল শহরে নাট্যাভিনয় করেও দারুন খুশি হন কলা কুশলিরা। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন এখানকার নাট্য পরিবেশনের পরিবেশ দেখে।
ছিল বাংলার বিভিন্ন নাট্যদলের প্রযোজনাও। চন্দন নগর যুগের যাত্রীর নাটক ‘স্বর্ণচাঁপা’ এবং লেকটাউন শ্রীভূমি সংসৃতির ‘সূর্য পোড়া ছাই’। দুটি নাটকই প্রশংসাধন্য। গোবরডাঙ্গার মাটিতে ফের তারা তাদের সুনামের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব –কৈশোর কেটেছে এই শহরেই। যৌবনে নাট্যচর্চায় হাতেখড়িও গোবরডাঙ্গাতেই। তাই ঘরের ছেলের নির্দেশিত নাটক দেখার একটা আলাদা আকর্ষণ বা ঔৎসুক্য ছিলই স্থানীয়দের মধ্যে। নিরাশ হননি তারা।
আয়োজক দল ‘গোবরডাঙ্গা নকসা’ প্রযোজিত চারটি নাটক ছিল এই নাট্যোৎসবে। ‘বিনোদিনী’, ‘তীরন্দাজ দামন’, ‘উজানে’ এবং নাসাবতী রাজকন্যা’। ভিন্ন স্বাদের, বিবিধ আঙ্গিকের এই নাটকগুলি ইতিমধ্যেই রাজ্য তথা দেশের নানা প্রান্তে সমাদৃত হয়েছে। নকসার অন্যতম সেরা এই প্রযোজনাগুলি ফের দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে।
নাট্যোৎসবে ছিল আরও নানা আয়োজন। প্রদর্শিত নাটকগুলির নির্দেশকদের নিয়ে ছিল ‘ডায়রেক্টরস মিট’। এতে পরিচালকদের সঙ্গে সরাসরি মত বিনিময়ের সুযোগ পেয়েছেন দর্শকেরা। নিঃসন্দেহে নাট্যপ্রিয় দর্শকদের জন্য এটা একটা বড় পাওনা। এগিয়ে যাওয়ার পথে এই মত বিনিময় রসদ যুগিয়েছে নাট্যনির্দেশকদেরও। সীমিত সংখ্যক ডেলিগেটদের নিয়ে ছিল গোবরডাঙ্গার ঐতিহ্য মণ্ডিত স্থানগুলিতে ভ্রমণের ব্যবস্থাও। এছাড়াও ছিল নাট্য বিষয়ক নানা আলোচনা, প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব খালেদ চৌধুরীর কর্ম জীবনের স্মৃতি মেদুর প্রদর্শনী।
মোট কথা শীতের আমেজ গায়ে মেখে কয়েকটা দিন জমজমাট থাকল নাটকের শহর গোবরডাঙ্গা। সৌজন্যে অবশ্যই গোবরডাঙ্গা নকসা আয়োজিত দ্বিতীয় জাতীয় নাট্যোৎসব।