স্বপ্ন এবং বাস্তব
অয়ন রায়
১
দুপুর ১২ টা এখন। আরও ঘণ্টাখানেক বাদে ইন্টারভিউটা হবে। টেনশন হচ্ছে? হ্যাঁ টা একটু হচ্ছে বইকি। প্রথমবার দিতে যাচ্ছে সায়ন্তন। একটু নার্ভাস বোধ তো হবেই। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। অক্ষয়দা বলেছিল, কিছু মানুষ আছেন যারা ভুলে জান যে তারাও একসময় ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। তখন তাদের সাথে যা হয়েছিল সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না করাটাই সমীচীন। অনেকে ভুলে যান সেটা। এমন মাথা ঘোরানো প্রশ্ন করে বসেন যে পালাতে পথ পায়না চাকরী প্রার্থীরা। কথা গুলো ভাবছিল আর সাথে সাথে বুকের ধুকপুকুনিটা বাড়ছিল।
সামনের চায়ের দোকানটাতে গিয়ে বসল। এক কাপ চা দিতে বলে ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে থাকলো সায়ন্তন। আরও ত্রিশ মিনিট। এবার যেতে হবে। চা টা খেয়ে নিয়েই অফিসে ঢুকতে হবে। বলা হয়েছিল আধা ঘণ্টা আগে চলে আসতে।
যেখানে যেতে হবে ,সেটা দশ তলায়। বিল্ডিঙের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে লিফটে উঠল। দরদর করে ঘামছে। জামাটা একেবারে ভিজে গেছে। কিছুক্ষণ যদিও সময় পাওয়া যাবে। ততক্ষণে শুকিয়ে যাবে। এ.সি বিল্ডিং এটা।
২
সে ইন্টারভিউ রুমে বসে এখন। সামনের টেবিলের ওপাশে যিনি বসে আছেন, বায়োডাটা দেখছেন। এবার সায়ন্তনের দিকে তাকালেন।
“আপনি আগে কোথাও কাজ করেছেন?”
“না স্যার এখানেই প্রথম ইন্টারভিউ দিচ্ছি।”
“আই সি । ওয়েল আপনার কোয়ালিফিকেশন বেশ ভালই। কিন্তু আমরা সাধারণত অভিজ্ঞদের বেশি নিয়ে থাকি । আরও পরিষ্কার করে বললে তাদেরই নিয়ে থাকি।”
“কিন্তু স্যার আপনাদের এডে তো নতুনদের ও সুযোগ দেওয়া হয় লেখা। আর সুযোগ না দেওয়া হলে নিজেকে প্রমাণ করব কি ভাবে?”
“আচ্ছা আপনি কি প্রশ্ন করতে এসেছেন না উত্তর দিতে? দেখুন সায়ন্তন ঘোষ আপনাকে অত প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমাদের কি চাহিদা সেটা বললাম । আমার মনে হয় আপনার অন্য কোথাও ট্রাই করা উচিত। যদিও সেখানেও নেবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ মার্কেটে এখন নতুনদের থেকে অভিজ্ঞ দের বেশি নেওয়া হচ্ছে। শুনছেন না কত কোম্পানি থেকে বাল্ক অফ এমপ্লয়ীজ স্যাক করা হচ্ছে। আমাদের টার্গেট তারাই। যাইহোক এখন আপনি আসতে পারেন।”
৩
আকাশটা বড় বেমানান আজ সায়ন্তনের মনের অবস্থার সাথে। শরতের শুরুতে যদিও এমনই থাকে। মেঘমুক্ত। ভেবেছিল পুজোর আগে একটা চাকরি জোগাড় করবে। কিন্তু সেটা হল না। না বাড়ির অবস্থা খারাপ নয়। কিন্তু প্রেম করার জন্য সবসময় টাকা চাইতে কেমন লাগে।তাছাড়া বাইরে বেরতেও তো খরচা লাগে। এই বয়সে সবসময় চাওয়াটাও উচিত নয়। বাবা, মা দিয়ে দেন কিন্তু নিজেকে ছোট মনে হয়। আঠাশ বছর হতে চলল। এখনও অব্দি বেকার। চারদিকে প্যান্ডেল সেজে উঠেছে, মাইকে গান। আজ তৃতীয়া।
প্রায় রোজ শনিবার সায়ন্তন অরুণের পাড়ায় যায়। একটা জায়গায় বসে দুজনে মদ খায়। অরুণ ভাল একটা কোম্পানীতে কাজ করে। মাস শেষে ভাল মাইনে। সে সায়ন্তনকে অনেকবার বলেছিল ওদের অফিস আসতে। কথা বলে রাখবে, শুধু ইনটারভিউটা দিয়ে চলে আসবে। অরুণের ভাল পজিশান কোম্পানীতে। চাকরী পেতে অসুবিধা হবে না সায়ন্তনের। সায়ন্তন তখন যায়নি কুড়েমির জন্য। কিন্তু এখন সেই বিলাসিতা দেখানোর সময় নেই । তিথির বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে ওর বাড়ি থেকে। ওর বাড়িতে জানেনা সায়ন্তনের ব্যপারটা। কিভাবেই বা বলবে তিথি, বেকার একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চায়! সায়ন্তন ভাবছিল কথাগুলো মদ খেতে খেতে। অরুণের কথায় ভাবনাগুলোকে আবার গুটিয়ে রাখল।
“কি রে কোন চিন্তায় এত মগ্ন লাটসাহেব ? তিথির?”
অরুণই একমাত্র ওদের সম্পর্কটা জানে। সে একটু হেসে বলল “ না রে ভাই। আজ ইন্টারভিউ ছিল। হল না। এক্সপেরিয়েন্স থাকা চাই।”
অরুণের মদের গ্লাসটা নামিয়ে রাখল । একটা সিগারেট ধরাল । সায়ন্তনকে একটা অফার করলো। ধরানোর পর বলল “দেখো বস। কিছু করার নেই। যখন বয়স ছিল শুনলে না আমার কথা। সব জায়গায় এখন এটাই চাইছে। কে আর ইনএক্সপেরিয়েন্সদের নিয়ে টানবে। এই অর্থনৈতিক মন্দার সময়টাতে এরকমই থাকবে। তোকে একটা ভাল কথা বলছি। ব্যবসার কথা ভাব। জব আর পাবিনা।”
সায়ন্তন চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। ব্যবসা! কিসের ব্যবসা কোথায় কিভাবে শুরু করবে সে? মুদির দোকান অলিতে গলিতে এখন। টিকতে পারবে না বেশিদিন। এটা ছাড়া আর কোনো ব্যবসা সে করতেও পারবে না।
“কি ভাবছিস?” অরুণ বলল। “এই ভাবতে ভাবতেই জীবনটা বেরিয়ে যাচ্ছে তোর। তাড়াতাড়ি ঠিক কর। নিজের ভালোটা বোঝ। কাকুকে গিয়ে বল। প্রথমে কিছু খরচা হবে। একবার দাঁড়িয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। যা করার জলদি কর। তিথি সেদিন ফোন করেছিলো। খুব কাঁদছিল। ওর বাড়ি থেকে ছেলে দেখা শুরু হয়ে গেছে। একজনকে পছন্দও হয়েছে। ছেলেটা আর ওর পরিবারেরও পছন্দ তিথিকে। তিথি এখনও মত দেয়নি। ওদের বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। ও বলছিল আমাকে যদি একটা চাকরী দিতে পারি। কিন্তু আমাদের অফিসে এখন রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে না। অনেক দেরী আছে। ও এটা ভাবছে তোর কথা ভেবে, যাতে তুই সময় পাস নিজেকে গোছানোর। আর ও বাড়িতে চাকরি করে কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারে বিয়েটা। অভাবের সংসার ওদের। তাই ওর বাবা-মা তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিতে চাইছেন মেয়ের।” বলে থামল অরুণ। গ্লাসটা এক ঢোকে শেষ করল।
সায়ন্তন সব কথা শুনে থ হয়ে গেল। তিথি এত কথা তো ওকে বলেনি! অরুণকে সব জানালো। মাথা হেট হয়ে গেল লজ্জায় তাঁর। নেশা বেশি হয়নি। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল সব।
৪
ট্রেন ঢুকবে একটু পরেই। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে সায়ন্তন। আজ অনেক খাওয়া হয়ে গেছে। তিথির কথাগুলো শোনার পর থেকে মাথাটা ঝিম ঝিম করছিল। অরুণের মানা শোনেনি। খেয়ে গেছে। শেষে অরুণকে বাধ্য হয়ে বোতলটা সরাতে হল। ও প্লাটফর্মে পৌঁছে দিয়ে গেছে। ট্রেন এখন স্টেশনে ঢুকছে। সেইসময় ফোন এলো। মোবাইলে চোখ ফেরাল। তিথি।
“হ্যালো”
“আমি একটা চাকরি পেয়েছি। ভাল স্যালারি দেবে। তোমার আজ ইন্টারভিউ কেমন হল।”
সায়ন্তন বলল সব। তিথি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল “দেখো সায়ন্তন তোমাকে আমি খুব ভালবাসি। তোমার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা ভাল চাকরি পেয়ে যাবে। কিন্তু আর কতদিন এভাবে চলবে। আমি আজ চাকরি পেয়ে কোনরকমে বাবা মার আমার বিয়ের জন্য তোড়জোড়টা বন্ধ করলাম আপাতত, তাবোলে তো সারাজীবন এভাবে চলতে পারেনা তাই না? তোমার উচিত একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া তাড়াতাড়ি। চাকরি না হোক অন্য কিছুতো করতেই পার। টিউশন, ব্যবসা। কিছু একটা তোমাকে ভাবতে হবে। আমি আর কত অপেক্ষা করবো।” ফোনটা কেটে দিল। শেষের কথাগুলো বেশ রেগেই বলল। অরুণ আর তিথির মধ্যে আমাকে নিয়ে ভালই আলোচনা হয়েছে। বুঝতে পারল সায়ন্তন।
ট্রেনটা বেরিয়ে গেলো কথা বলতে গিয়ে। এখন রাত ১০ টা। এরপর সেই ১০.৩০ এ । মনোহরপুর নেমে আর অটো পাওয়া যাবে না এত দেরী হলে। এখান থেকে অটো যায় ,ওর বাড়ির কাছাকাছি। খরচা বেশী হবে,কিছু করার নেই। অগত্যা তাই স্টেশন থেকে নেমে এলো সায়ন্তন। এদিকটা বেশ নির্জন এখন। গাড়ি- ঘোড়া বেশ কম। একটা লোক পাশ দিয়ে চলে গেলো। দেশি মদের গন্ধ। একসময় খেত। এখন আর পারেনা। গন্ধটা বিদঘুটে লাগে। দূরে একটা অটো দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। হাত দেখাল সায়ন্তন। সামনে এসে থামল, পিছনে তিনজন সামনে একজন বসে। সায়ন্তন আর দেরী না করে উঠে পড়ল।
অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে একই জায়গায় অটোটা। টায়ার পাংচার হয়ে গেছে।সারাতে অনেকটা সময় লাগবে । সায়ন্তনের বাড়ি এখান থেকে আরও সাত- আট কিলোমিটার । বাকিদের কাছে বাড়ি তাই তারা নেমে গেল সেখানেই। ড্রাইভার বলল “ দাদা আমার বাড়ি এখানেই ।এত রাত হয়ে গেছে।ফেরার সময় কোনো লোক পাব না নিয়ে যাওয়ার। আপনি দেখুন কোনো অটো পেয়ে যাবেন। আমি দেখলেই দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি।”
নেশার রেশ অনেকটা কেটে গেছে এখন। বেরিয়ে এল সায়ন্তন। এখন কিছু পাওয়ার আশা প্রায় কম বিশেষ করে এদিকটাতে। রাত ১০.৪৫। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল । কালো কাঁচ জানলায়। ভিতরের আরোহীকে দেখা যাচ্ছেনা। এবার কাঁচটা খুলল। একজন খুব সুন্দরী ভদ্রমহিলা চালকের আসনে। পরনে নীল রঙের শাড়ি।শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল সায়ন্তনের । চোখ দুটিতে কিছু একটা আছে, ফেরান যাচ্ছেনা।
সম্বিত ফিরল তাঁর গলার আওয়াজে।“ কোথায় যাবেন?”
সে বলল “ তীর্থ পিঠের সামনে নামবো।”
“আমি ওদিকেই যাচ্ছি। ভয় না থাকলে আসতে পারেন।”
ভয়ের কি আছে। এখন কোনমতে বাড়ি ফিরতে পারলে বাচে সায়ন্তন। ঘরে কি অপেক্ষা করে আছে জানেনা । এমনিতেই চাকরী বাকরি নেই। গায়ে মদের গন্ধ পেলেই হল । আজ আবার বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন। বাকি দিনগুলিতে ১১ টা বেজে যায়। বাবা থাকলে জবাব দিতেই হয় কোথায় গেছিলাম। নাহলে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মাকে বলা থাকে খেয়ে আসবে বন্ধুর বাড়িতে ডিনার।
“না কোনো প্রব্লেম নেই। আপনি লিফট দিলে ভালই হয়। এই রাতে আর কিছু পাওয়া যাবে না। আপনি অনেকটা ভগবানের মতন এলেন।”
“ভগবান!” কথাটা বলে জোরে হেসে উঠলেন ভদ্রমহিলা ।“ বেশ ভাল বললেন কথাটা। আসুন উঠে আসুন।” বলে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন তিনি।
৫
গাড়ি চলছে। জানলার কাঁচ খোলা। হাওয়ায় উড়ছে ওনার চুল। নামটা জানা হল না। ভেবে জিগ্যেস করতে গেল সায়ন্তন।
“আমার নাম তন্দ্রিমা।” হেসে আমার দিকে ফিরে বললেন ভদ্রমহিলা। “ আপনাকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। চিন্তা করবেন না। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবেন।”
“না সেই চিন্তা নেই। আসলে অন্য চিন্তা।” বলে ছুপ করে গেল সায়ন্তন। অজানা অচেনা কাউকে নিজের ব্যক্তিগত কথা না বলাই ভাল ।
“কি গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে ? ও ভাববেন না ।ঠিক হয়ে যাবে। আমার সাথেও আমার হাজব্যান্ডের ও খুব ঝগড়া হত। কিন্তু ভালবাসাও ছিল। এখন সেটা খুব মিস করি।”
একটু অস্বস্তি নিয়েই জিগ্যেস করল সায়ন্তন “ এখন কোথায় উনি?”
“উনি এখন অনেক দূরে। হ্যাঁ রোজ দেখতে পাই এটা ঠিক, কিন্তু …… থাক আমার কথা বাদ দিন। আপনি কি করেন জানা হল না।”
কি বলবে বুঝতে পারল না । কিছুই তো করে না সে । বলল “ ছোটখাটো একটা কাজ করি।”
“ঠিক বললেন না কথাটা। কোনো কাজই ছোট না। আপনি কিভাবে সেটা দেখছেন, সেটার উপর নির্ভর করে। যাক আপনার ব্যক্তিগত ব্যপার। আমি আবার একটু বেশি কথা বলে ফেলি। আসলে কথা বলার মতন মানুষ তো পাইনা। কিছু মনে করবেন না।”
“আপনি কোথায় থাকেন?” জিগ্যেস করল সায়ন্তন।
“আমি ?আপনি যেখানে নামবেন তাঁর কাছেই। একাই থাকি এখন। কি করব চাইলেও পারিনা মানুষদের মধ্যে থাকতে।”
কথাবার্তা বেশ অদ্ভুত মহিলার। মানুষদের মধ্যে? উনি নিজেকে কি মানুষ ভাবেন না?
সায়ন্তনের মনের কথা কি করে যেন বুঝতে পারলেন তন্দ্রিমা। তাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন “ কি? ভাবছেন আমি বেশ অদ্ভুত কথা বলছি তাই না? আসলে আমি এমনই। আগে এমন ছিলাম না। কিন্তু একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। সব পালটে গেলো। যাক গে। বাদ দিন। আপনার বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি।”
তীর্থ পিঠের সামনে গাড়ি এসে থামল । নেমে পড়ল সায়ন্তন। তাঁর দিকে ফিরে বলল “ কি ভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব? আপনি না থাকলে হয়ত হেঁটেই আসতে হত এতটা পথ।”
“সেটা কোনও ব্যপার না সায়ন্তন বাবু। আমি না থাকলে অন্য কেউ থাকতো।” হেসে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন তিনি।
থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সায়ন্তন। নামটাই তো বলা হয়নি ওনাকে। তবু কিভাবে জেনে গেলেন! চোখ চলে গেল গাড়িটার দিকে। দেখতে পেল না। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। দূরে একটা কুয়াশা মতন কিছু মনে হল। এই সময়ে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। হতে পারে চোখের ভুল। নেশাটা যে পুরোপুরি কাটেনি এখনও। সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
৬
টেবিলের ঘণ্টাটা বেজে উঠল হঠাৎ। নিজেই কখন বাজিয়ে ফেলেছে, সেই আওয়াজেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। লোডশেডিং ছিল, তার সাথে জেনারেটর খারাপ। সেজন্য ইন্টারভিউ শুরু হতে দেরী হয়ে গেলো। ঘণ্টা বাজার অর্থ কারেন্ট এসেছে। সায়ন্তন নিজেকে গুছিয়ে নিল। টাইটা ঠিক করে নিল। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ। স্বপ্নের চরিত্রগুলো অচেনা। এমনভাবে দেখান হচ্ছিল মনে হচ্ছিল, তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে সব। আজগুবি মনে হচ্ছে এখন। ভাবতে লাগল স্বপ্নটা নিয়ে।
কিন্তু ভাবনায় ছেদ পড়ল।“ মে আই কাম ইন স্যার?” একটা মেয়েলি মিষ্টি কণ্ঠে চমকে উঠল সায়ন্তন। গলাটা খুব চেনা চেনা লাগছে! চোখ তুলে তাকাল। সেই শিরদাঁড়ায় শিহরণ। চন্দ্রিমা! হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরল না তাঁর। কি করে সম্ভব?
“স্যার আসব কি?” খেয়াল হল মেয়েটা দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার সামনেই। এতটা বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়েছিল যে ভিতরে আসার অনুমুতিটুকুও দিতে পারেনি সে।
“ইয়েস কাম ইন।” সায়ন্তন বলল।
মেয়েটা এসে বসল। হাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছে। হয়ত মজা পেয়েছে ওর অবস্থা অবস্থা দেখে। গাম্ভীর্যটা ফিরিয়ে আনল এবার ।
“বসুন। আপনার সি.ভি এনেছেন?” বলে টেবিলে রাখা জলটা খেতে যাবে, তখনই অনুমতি না নিয়েই যে দুজন রুমে এলো, জলটা আর খাওয়া হল না। স্বপ্নে সায়ন্তনের বন্ধু অরুণ। আর সাথে যে এসেছে তাকে দেখে বেশ চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে বুঝতে পারল না। দুজনেরই কর্পোরেট পোশাকতাঁদের অফিসের ড্রেস কোড। কিন্তু এদের কখনও দেখেনি এখানে।
ওদের মধ্যে মেয়েটি বলল “স্যার কিছু সই চাই ফাইলগুলোতে”, বলে এগিয়ে দিল কিছু কাগজের মতন বস্তু। গলাটা এবার চিনতে পেরেছে। স্বপ্নে তাঁর বান্ধবীর গলার মতন! অবাক হওয়াটা বুঝতে না দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেগুলি নিল সায়ন্তন। চোখ পড়তে দেখল সেখানে কিছু লেখা নেই। সাদা পাতা সবকটাতে!
“এখানে কি সই করবো। কিছুই তো লেখা নেই।” বলে তাকাল তাদের দিকে। এবার তিনজনে একসাথে হাসতে লাগলো। হাসির জোর বাড়তে থাকলো। জোরে, আরও জোরে। সায়ন্তন কান চাপা দিয়েও আটকাতে পারল না। তারা এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছেনা না সায়ন্তনের।
ভয়ে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে প্রায়। একি দেখছে সে। মানুষের জায়গায় তিনটি কঙ্কাল তিনদিক থেকে ঘিরে রয়েছে তাঁকে!
৭
সায়ন্তনের রুমে এখন অফিস স্টাফদের ভিড়। তাঁর মৃতদেহ চেয়ারে পড়ে রয়েছে। চোখে ভয়ের ভাব । মৃত্যুর কারন পরিষ্কার নয়। টেবিলের উপর তিনটে বায়োডাটা পড়ে, সেখানে রিজেকটেড লেখা।