দূর্গাপূজা

বিদিশা মন্ডল, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

আজ অষ্টমী। সোনারপুকুর গ্রামের জমিদারবাড়ি জমজমাট। পূজোর সময় আত্মীয়পরিজনের ভিড় জমে। কেউ আসে কলকাতা থেকে, কেউ বেঙ্গালোর, কেউ বা সুইজারল্যান্ড। আর এই পুজোর ভোগের রান্নার সমস্ত দায়িত্ব পরে ব্যানার্জী বাড়ির বামুনঠাকুরদের ওপর।
আজ মেনু দেরাদুন চালের ভাত, বেগুন ভাজা, শাক, মুগের ডাল, আলুর দম, ফুলকপির ডালনা, আমের চাটনি আর দুধের পায়েস। এবারের রান্না করবে ব্যানার্জীদের বর্ত্তমান দশমপুরুষ রতু ওরফে রতন ব্যানার্জী। তার ছেলে হলো মনু, ক্লাস ফাইভের ছাত্র। আজকের রান্নার পর রতন যে টাকা পাবে তা দিয়ে ছেলের জন্য নতুন জামা কিনে তবে বাড়ি ফিরবে। উৎসবের দিনে ছেলেটাকে একটা জামাও কিনে দিতে পারেনি তার গরীব বাবা। এদিকে ছেলে বায়না ধরল সেও বাবার সাথে জমিদারবাড়ি যাবে। সেখানে কতবড় পূজো হবে, কত লোকজন সেইসব সে দেখবে। বাবারও না মেনে আর উপায় রইল না।
” চল বেটা কিন্তু একদম দুষ্টুমি করবি না কথা দে, উরা বড়োলোক, আর আমরা ছোট আদমি, মনে রাখবি কিন্তু”
” ঠিক আছে বাবা, তুমি কোন চিন্তা করোনা, আমি তোমার পাশে চুপটি করে বসে থাকব, কোথায়ও যাবো না”
এই বলে ছেলে বাপে বেরিয়ে পড়ল জমিদারবাড়ি। যাবার পথে ছেলের সে কি আনন্দ। আকাশে বাতাসে উৎসবের রং লেগেছে। চারিদিকে কাশফুলের মেলবন্ধন তাকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। আশ্বিনের সেই ছন্দময় দিনে মায়ের অঞ্জলি।
“এসো এসো রতন, তোমায় রান্নাঘরে সব বুঝিয়ে দিই, এই কে আছিস, ওদের সব দেখিয়ে দে”- জমিদারবাড়ির কর্তা বুড়ো প্রতাপনারায়ন কথাটা চাকরদের উদ্দেশ্য করে বললেন
দুজন চাকর এসে রতনদের নিয়ে গেল পূজোর দালানকোঠার দক্ষিনদিকে রান্নার জায়গায়। এদিকটা একটু সুনসান। ভালোই। বেশ নিরিবিলিতে রান্না করা যাবে। রতন কাঁধের ঝোলাটা রাখল পাশের বেঞ্চিটার ওপর। এতে আছে পাতায় মোড়া আদা, জিড়ে বাটা, তেজপাতা, পাঁচপোড়ন ইত্যাদি রান্নার সামগ্রী। এরপর সামনের বিশাল থামওয়ালা বারান্দার পাশের চৌবাচ্চা থেকে দু বালতি জল ঢেলে কাচা কাপড় পরে শুরু করলেন ভোগের রান্না।
ওদিকে মনু বিস্ময়ে তাকিয়ে চারিদিক দেখে। কত বড়ো বাড়ি, এই বাড়ির সাথে তাদের খড়ের চাল দেওয়া মাটির বাড়ির কোন মিল নাই। আশেপাশে খেলা করে বেড়াচ্ছে তারই বয়সি কতগুলো ছেলেমেয়ে, কিন্তু তাদের পরনে দামি পোশাক আর তার পরনে ছেঁড়া প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি এই যা পার্থক্য। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনু। হঠাৎ তার চোখ গেল এবাড়ির সবাই ব্যস্ত একটা দুরন্ত বাচ্চার পেছনে। বয়স দুবছর হবে। সবে হাটতে শিখেছে। খুবই দুষ্টু, খালি দৌড়ে এদিক আর ওদিক। বড়োরা তাকে আটকাতে হিমশিম খাচ্ছে।
ওদিকে ঠাকুরদালানে “তাকটি নাকুড় নাকুড়” করে ঢাক বাজছে। মনু হাঁ করে তাকিয়ে দেখে দেবীপ্রতিমাকে। আহা! কি রূপ। লাল শাড়ি, গা ভর্তি গয়না, কপালে চন্দর আর সিঁদুরের যুগলবন্দীর টিপ আকাঁ। ঠিক যেন মা। মাই তো, ইনি জগতজননী মা, গরীব বড়োলোক সবার মা।
ওদিকে রান্নাঘরে ফিরে এসে সে দেখল বাবা ইতিমধ্যে দুটো ইটের উনুনে আগুন দিয়ে ফেলেছে। শাক কাটা শেষ, ফুলকপি কেটে জলে ভেজানো আছে, আলুর খোসা ছাড়িয়ে তেল পাড়ছে বাবা। ওদিকের উনুনে ভাল বসানো হল। এদিকে আলু ভাজা হলে সেগুলো তুলে তেলে পাঁচপোড়ন আর তেজপাতা দেওয়া হলো। আহা! কি সুগ্রান, সেই গন্ধে পূজোর পরিবেশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
মনু তাকিয়ে তাকিয়ে রান্নার তদারকি করতে লাগল। বাবার পর তো তাকেই সব সামলাতে হবে। তবে আগে সে অনেক লেখাপড়া করবে, শিক্ষিত হবে, বড়ো চাকরি করবে, বাবার কষ্ট ঘোচাবে। তারপর শুধু পুজোর সময় রান্না করতে আসবে। অনেক স্বপ্নে তার দুচোখ বিভোর।
এরই মধ্যে জল শেষ হয়ে যাওয়ায় রতন ড্রাম হাতে গেল জল আনতে। হঠাৎ জমিদারবাড়ির সেই দুরন্ত বাচ্চাটি সবার অলক্ষ্যে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। উনুনে তখন বড়ো কড়াইয়ে গরম তেলে ফুলকপি ভাজতে দেওয়া আছে। বাচ্চাটিকে ধরার জন্য তার মা সহ আরো করেকজন তখন পেছনে ছুট লাগিয়েছে।
এমনসময় বাচ্চাটি গরম কড়াইয়ের দিকে ছুটে গেল। নির্বোধ শিশু গরম তেলকে খেলার বস্তু ভেবে খিলখিল হেসে এগিয়ে গেল তারদিকে। সর্বনাশ, পুজোর দিনে একি অঘটন। শিশুটির মা ততক্ষনে চিতকার করে উঠল, ভয়ে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। কেউ বাঁচানোরও সময় পেল না।
ঠিক সেই সময় আরেকটা কচি হাত বাচ্চাটিকে আটকে নিল। ধমকের সুরে বলে উঠল-
” এইভাবে কেউ ছোটে নাকি, এক্ষুনি তো পরে যেতিস গরম তেলে, তখন কি হতো বলত”- ভেবেই শিউরে উঠল মনু।
” ও আমার সোনা বাবুটা, তোর কিছু হয়নি তো”- কেঁদে উঠল শিশুটির মা। অবোধ কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। ততক্ষনে চিতকার শুনে বাড়ির বাকিরাও ছুটে এসেছে রান্নাঘরে। সবাই মিলে তখন মনুকে বাহবা দিচ্ছে, ধন্যবাদও তাদের বংশের ছেলের প্রানরক্ষার জন্য। রতনের চোখে তখন জল। এ জল গর্বের। ছেলের গর্বে।
রান্নাবান্না মিটে গেলে তারা তাদের মাটির ঘরে ফিরে এল। এসে দেখা গেল প্রতাপনারায়ন রতনকে টাকার সাথে সাথে একটা প্যাকেটও দিয়েছেন সেটা শুধুমাত্র মনুর জন্য।
মনুর আর তর সইছিল না। সামনের গোলাঘরের কাছে এসেই প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেলল।
ওরমধ্যে ছিল ঝকঝকে একটা জামা আর প্যান্ট আর একটা চশমাও। আবার ৫০০ টাকার একটা নোটও পুরস্কার বাবদ। এইতো সে পেরেছে বাবার কষ্ট ঘোচাতে। আজ বাবা ওর জন্য কত খুশি। তবে এই সবই সম্ভব হয়েছে মা দূর্গার আশীর্বাদে…জয় মা দূর্গা, জয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × three =