মমার্ত ও লাশকাটা ঘর
হিল্লোল ভট্টাচার্য
প্রতিটি দিন আগের থেকে আরো বেশি অসহনীয় হয়ে উঠছে, রাত গুলো গাঢ়তর, আরো দুঃস্বপ্নময়। একজন লোক চেঁচিয়ে কিছু বলতে চাইছে, কেউ শুনছে না। শুনলেও উপলব্ধি করতে পারছে না। পরিষ্কার বুঝতে পারছে তমোঘ্ন, এই স্কুলের চাকরি টাও যাবে। নিয়তির অমোঘ বিধান, দেওয়াল লিখনের মত স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। এক ছোট শহরের একটা অখ্যাত স্কুলের আর্ট টিচার সে। প্রাণপণ চেষ্টা করে ছেলেদের কে ছবি আঁকা শেখাতে, তার মত করে। কিন্তু কিছুতেই যেন কেউ সন্তুষ্ট হচ্ছে না।
তার ছবি গুলো ঠিক বোঝা যায় না, কেমন যেন অন্যরকম। ফুল, পাখি, পাহাড়, ঢেউ এ দোল খাওয়া নৌকো – এসব ই শেখাবার বোধ হয় কথা ছিল। এটাই প্রত্যাশা ছিল, ছোট শহরের এক আর্ট টিচারের কাছে। প্রথম, প্রথম ছাত্ররা অবাক হত, মুখ চাওয়া চাওয়ি করত। এখন রীতিমত হাসাহাসি করে। এর পর পেছনে লাগল কিছু অভিভাবক।
“এ সব কি আঁকছেন আপনি, স্কন্ধকাটা নারীমূর্তির মধ্য থেকে ধোঁয়া উঠছে, তারপর কিছু ধর্মযাজক মদের বোতলের মত কিছু পরিবেশন করছে, তার সঙ্গে আবার সমুদ্রমন্থন, মোহিনী নারী? এ কি কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং ছবি?”
দু-দুবার স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ডেকে সমঝানোর চেষ্টা করেছে, সাথে মৃদু সাবধানবাণী। সব থেকে রাগ হয় যখন লোকে বলে, “কি আঁকেন ময়? মাথামুণ্ডু নেই!”
তারপর অশ্লীল ছবির খোঁটা তো আকছার শুনতে হয়।
তমোঘ্নর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “কিছু বোঝ না তোমরা, নির্বোধের দল! আর্টের কিছু জান না।”
কলকাতায় যদি একটা…একটা এক্সিবিশনের ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে হয়ত তার কদর বুঝত কেউ, কেউ হয়ত স্বীকৃতি দিত। কিন্তু প্রদর্শনীর খরচ বহন করা তার ক্ষমতার বাইরে, আর এই পাগলামির জন্য কেউ টাকা ধার দেবে না।
একজন শিল্পীর কাছে এর থেকে যন্ত্রণার আর কি বা হতে পারে? তার সন্তানতুল্য শিল্পকর্ম চারপাশের লোকজন বুঝছে না। সমকাল তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে, উপহাস করে। রাত্রে স্বপ্নে কতগুলো লোক রোজ হাসাহাসি করে তার দিকে আঙুল তুলে, কেউ সিগারেটের ছাই ঝাড়ে ছবির ওপরে, কেউ বলে, “মুড়ির ঠোঙা বানাও হে”!
মদের মাত্রা বাড়ছে হতাশার সাথে পাল্লা দিয়ে। লিভার ফাংশন আর গ্যাস্ট্রাইটিস দুটোই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ডাক্তারের বারবার বারণ সত্তেও তার জীবনযাত্রা কিছুতেই ঠিক পথে আনা যাচ্ছে না। ওদিকে স্কুলের হুঁশিয়ারি কেও পাত্তা না দিয়ে তার ছবির ধরন পালটায়নি সে। একগুঁয়ে, খুব জেদী একটা শিশু, কোনমতেই তাকে বোঝানো যায় না। দু চার জন যা অবিশিষ্ট শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল, তারাও বলে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
এই সময় হয়ত সামলাতে পারত শীলা…..যদি পাশে থাকত। শীলা স্থিরতা চেয়েছিল, নির্ভরতার ছাদ চেয়েছিল একটা। এই দামাল বন্য যুবকের পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব হয় নি। বছর চারেক আগে শীলা চক্রবর্তী থেকে ব্যানার্জী হয়েছে, দক্ষিণ কলকাতার কোথাও একটা শ্বশুরবাড়ি তার।
তমোঘ্ন এক সময় স্বপ্ন দেখত প্যারিসের মমার্তের রাস্তায় ছবি আঁকছে। বহু পৃথিবীবিখ্যাত আর্টিস্টের পদধূলিধন্য চিত্রশিল্পের মক্কা মমার্ত।
কানাঘুষোয় শোনা যায় অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড, প্রভাতবাবু নাকি স্টাফরুমে একবার সকৌতুক মন্তব্য করেছিলেন,
“তা উনি যে রকম আঁকেন, তাতে পথে বসা ছাড়া আর গতি কি?”
তার ডায়েরি তে লেখা শেষ লাইন গুলো প্রিয় কবি জীবনানন্দের থেকে ধার করা,
“অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত, ক্লান্ত, ক্লান্ত করে।
লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই
তাই…..”
.
.
.
.
মৃত্যুর ২৫ বছর পর আধুনিক শিল্পের অন্যতম বড় নাম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া তমোঘ্ন বসুর প্রদর্শনী তে, তার জীবনের সারসংক্ষেপ জানালেন আর্ট কলেজের বিশিষ্ট অধ্যাপক। মাস্টারপিস ছবি গুলোর দাম প্রায় কোটির ঘরে।
তমোঘ্নর আত্মপ্রতিকৃতি টা কেমন যেন ব্যাঙ্গের হাসি হাসছে। আঁচলের খুঁটে দু ফোঁটা জল মুছলেন প্রদর্শনী দেখতে আসা বর্ষীয়সী শীলা ব্যানার্জী।