শীতের শাক সবজি ও ফলমূলের খাদ্য গুণ

বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফেমিং গবেষণাগারে ছোট ছোট কাচের পাত্রে ব্যাকটেরিয়ার কালচার (চাষ বা বংশবৃদ্ধি) করতেন। একদিন তিনি দেখলেন, তার কালচার করা একটি পাত্রের এক পাশে এক প্রকার ছত্রাক জন্ম নিয়েছে, যা এর আশপাশের সব ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলেছে। তিনি প্রকৃতির এই ভাষা বোঝার জন্য আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি গবেষণা করে বুঝতে পারলেন, এটি ছিল পেনিসিলিয়াম-জাতীয় ছত্রাক এবং এর রয়েছে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী ক্ষমতা। এই ছত্রাক থেকে তিনি প্রস্তুত করেন পেনিসিলিন নামে অ্যান্টিবায়োটিক। প্রকৃতির না বলা নিশ্চুপ ভাষা বুঝতে পারার ফলে তিনি সফল হয়েছিলেন পেনিসিলিন নামে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে।
এই ঘটনা প্রকৃতির ভাষা অনুধাবন করা ও নিজেকে সফল বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এক আদর্শ উদাহরণ। বর্তমানে আমাদের মাঝে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক প্রচেষ্টা চলছে। আমাদের মাঝে শীতের সবজি (যেমন টমেটো, সিম, ফুলকপি ইত্যাদি) গ্রীষ্মে এবং গ্রীষ্মের ফল (আম, তরমুজ ইত্যাদি) শীতে ফলানোর এক অসুস্থ প্রবণতা জন্ম নিয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমরা ভেবে দেখিনা, গ্রীষ্মের ফলগুলো আমাদের শীতের দিনে গ্রহণের তেমন কোন প্রয়োজন নেই। গরমের দিন আমরা সাধারণত একটু বেশি ঘামি। ফলে দেহ থেকে বেশি পরিমাণ নুন ও জল বের হয়ে যায়। আর এই নুন-জলের ঘাটতি পূরণ ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য তখন প্রকৃতিতে ফলে অসংখ্য রসালো ফল। শীতের দিনে যেগুলো গ্রহণ বিলাসিতা ও অপচয় ছাড়া কিছু নয়। কারণ, গ্রীষ্মের ফলের সে টাকায় আমরা প্রায় তিনগুণ পরিমাণ শীতের সবজি কিনতে পারব, যা নিশ্চিত করবে আমাদের সুস্বাস্থ্য, মেটাবে পুষ্টির ঘাটতি। এবার শীতের দিনের কিছু শাক সবজি ও ফলমূলের ঔষধিগুণ নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

টমেটো : টমেটো শীতের দিনের এক অসাধারণ সবজি, যা সবার নজর কাড়ে এবং স্বাদেও অতুলনীয়। টমেটোর এত সুন্দর বর্ণ তাতে থাকা লাইকোপেনের জন্য হয়ে থাকে। লাইকোপেন টমেটোর মূল কার্যকর রাসায়নিক উপাদান এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণ সম্পন্ন। তাই টমেটো ক্ষতিকর এলডিএলের অক্সিডেশন প্রতিরোধ করে আমাদের হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ ও সবল রাখে। তাছাড়া টিউমার ও ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণেও টমেটো সহায়তা করে।
বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি ও মুলো : সবই শীতের খুব সুস্বাদু সবজি। এ সবজিগুলোয় রয়েছে সালফোরাফেন ও ইনেডোল-৩কার্বিনল, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে এবং ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কার্যকর। এ সবজিগুলোর মধ্যে মুলোকে আমরা অনেকেই হেয় করে থাকি এবং নিম্নমানের সবজি মনে করি। অথচ এই মুলো ক্যান্সার প্রতিরোধের পাশাপাশি পেটের সমস্যা ও প্রস্রাবের সমস্যা নিরসনে সহায়তা করে। তাই শীতে এই সবজিগুলো আমাদের বেশি বেশি গ্রহণ করা উচিত।

গাজর : গাজর শীতের আরেক আকর্ষণীয় সবজি। এর রঙ আমাদের সবাইকে আকর্ষণ করে। আর এই সুন্দর বর্ণের মধ্যে রয়েছে এর ঔষধিগুণ। গাজরের এই রঙের কারণ হলো এতে থাকা বিটাক্যারোটিন। বিটাক্যারোটিন আমাদের দেহের ভেতরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে রেটিনল বা ভিটামিন-‘এ’ তে পরিণত হয়। আর এই ভিটামিন-‘এ’আমাদের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, চোখের পাশাপাশি গাজর আমাদের ত্বকের সুরক্ষাও প্রদান করে। গাজরের বিটা ক্যারোটিন আমাদের ত্বককে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে সুরক্ষা দেয় এবং ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে।

পালংশাক : শীতের সবজিগুলোর মধ্যে আরেকটি পুষ্টিকর সবজি হলো পালংশাক। এতে রয়েছে ভিটামিন, এসি ই সহ আরো অনেক ভিটামিন ও খনিজ। তাই আমাদের দেহের পরিপূর্ণ পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পালং শাক খুবই প্রয়োজনীয়।
আঙুর : শীতের ফলের মধ্যে আঙুর অন্যতম। আঙুরে রয়েছে রেসভেরাট্রল ও প্রো-অ্যান্থোসায়ানিডিন নামক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। তাই আঙুর ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। এ ছাড়া অকাল বার্ধক্য প্রতিরোধে আঙুর অদ্বিতীয়।
আমলকী : শীতের ফলগুলোর মধ্যে আমলকী আরেকটি সুস্বাদু ফল। আমলকীকে বলা হয় ভিটামিন ‘সি’-এর রাজা। আর এই ভিটামিন সি আমাদের ত্বকের সুরক্ষা, মাঢ়ি মজবুত করতে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
কমলালেবু : কমলালেবু ভিটামিন-‘সি’ সমৃদ্ধ এক অনন্য ফল। এই শীতে কমলালেবু আমাদের ত্বক সুরক্ষা করতে সহায়তা করে। আমরা সবাই কমলালেবুর শুধু ভেতরের রসালো অংশ খেয়ে থাকি এবং এর বাকল ফেলে দিই। অথচ এই বাকলে রয়েছে প্রচুর পেকটিন, যা আমাদের পরিপাক তন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। তাই কমলা বাকলসহ জুস করে খাওয়া অধিক স্বাস্থ্য সম্মত, পুষ্টিকর ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন।
আমাদের সকলেরই সব ঋতুর সব ফল ও সবজি অন্তত একবার গ্রহণ করা উচিত। কারণ, প্রতিটি ফল ও সবজির রয়েছে আলাদা আলাদা ঔষধি ও পুষ্টিগুণ। তাই আসুন, আমরা আমাদের চারপাশের শাক সবজি ও ফলমূলের ঔষধিপুষ্টি গুণ জানি এবং এগুলো গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ ও সুন্দর জীবন লাভ করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 − 8 =