প্রেমের সকাল
মহেশ্বর মাজি, ধবন, বাঁকুড়া
অনির্বানের আজ ছুটি। অনিমা সকাল থেকে ঘর পরিস্কার করতে লেগে গেছে। মাথায় একটা টাওয়াল জড়িয়েছে। খাটো মত একটা পুরনো নাইটি পরে, হাতে লম্বা একটা ডাস্টার নিয়ে ঘরের কোনগুলোকে আগে পরিস্কার করছে। রীতিমত গলদঘর্ম অবস্থা। অল্প,স্বল্প কালি,ঝুল ওর সুন্দর চিকন মুখটায় লেগে আছে। টাওয়ালের ফাঁকে দু-এক গোছা সিল্কি চুল বেরিয়ে গেছে। ঘামের সাথে সেগুলো ঘাড়ের কাছটায় লেপ্টে রয়েছে।
অনির্বান ব্যাল্কনিতে বসে পুজো সংখ্যার কবিতাগুলো মন দিয়ে পড়ছিল। হঠাৎ অনিমাকে এই অবস্থায় দেখে চেয়ার ছেড়ে দৌঁড়ে বেডরুমে ঢুকল। চার্জার থেকে মোবাইলটা বের করে চক্ চক্ করে গোটা কয়েক পিক তুলে নিল।
অনিমা সহজভাবেই বলে উঠল
–ফেবুতে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবে!..খুব মজা পাবে ওরা?..একটু হেল্প করো তো। ও সব ফাঁজলামি বন্ধ করে।
অনির্বান মোবাইলটা চার্জারে বসিয়ে এসে বলল
–এই সব পোষ্ট করে আমি জেলে যেতে চাইনা। শেষে বধূ শোষনের দায়ে ফেবুতে কমেন্টের ছয়লাপ হবে। সবাই বলবে। স্বামী আরাম কেদারায় বসে, স্ত্রীকে নাকে দমে খাটাচ্ছে।
অনিমা আদেশের সুরে বলে উঠল
–অনেক হয়েছে কত্তাগিরী। এবার এদিকে এসো। আমাকে ধরে একটু তোল দেখি। ওদিকটা বাকি রয়ে গেল। নাগালে আসছে না।
–স্বামী হয়ে শেষে তোমার পা ধরব?
–সে সময় এখনো আসে নি মশাই। আপাতত কোমরটা ধরো।
–তোমার কোমরে বড্ড কারেন্ট আছে। এই সাত সকালে ঝটকা খেতে মন চাই না। ওটা আমার হাতে দাও। দেখি কি করা যায়?
অনিমা চোখের তারায় অনির্বানকে শাসন করার ভঙ্গীতে ওর হাতে ডাস্টারটা ছুড়ে দিল।
অনির্বান টেবিলটা টেনে সামনেটায় রাখল। তার উপর সেগুন কাঠের ভারি চেয়ারটা সেট করল। তারপর অনিমাকে বলল
–তোমার দায়িত্ব চেয়ারটা শক্ত করে ধরা। আমি উঠছি কিন্তু।
অনিমা চেয়ারটা ধরে বলল
–ছ্যা..তুমি আচ্ছা বেহায়া তো।
অনির্বান মনযোগ দিয়ে মাকড়শার জালগুলো টেনে বলে উঠল
–হঠাৎ এতবড় উপাধী দেওয়ার কারণটা কী জানতে পারি?
–তুমি লুঙ্গির নিচে জাঙ্গিয়া পরোনি কেন?
–ও..এই জন্য!..তা তুমি কি কিছু দেখলে?
অনিমা মাথার টাওয়েলটা টেনে বলে উঠল
–আমার জ্বালা ধরেনি!
–তাহলে জানলে কি করে?
–তুমি নামবে?…না বাবা রামদেবের প্রাণায়ামটা ওখানেই সারবে?
অনির্বান পড়িমড়ি করে নেমে গেল।
অনিমা যেতে, যেতে বলল
–আজ বেশি সময় নেই। একটু তাড়াতাড়ি করে উপমা করে দিচ্ছি। চলবে তো?
অনির্বান দৌড়ে গিয়ে অনিমার হাতটা ধরে ফেলল
–তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে আগে বাথরুমে স্নানটা সেরে এসো। তোমাকে এই চেহারায় মোটেও বিউটি বলে মনে হচ্ছে না। নাস্তায় আজ আমি কিছু স্পেশাল বানাতে চাই।
অনিমা, ফিল্মি কায়দায় এক পাক ঘুরে অনির্বানের গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল
–ও..রিয়েলি!
–ইয়েস ম্যাডাম।
–ওকে। পুরস্কারটা রাত ছাড়া আশা করো না।
তারপর দুজন দুদিকে চলে গেল।
অনিমা বাথরুম থেকে বেরিয়েই একটা সুন্দর গন্ধ পেল। এতক্ষণে খিদেটাও চাগাড় দিয়ে উঠল। কোন রকমে একটা নাইটি গলিয়ে ভিজে চুলেই রান্না ঘরে দৌঁড়ে এল।
অনির্বান তাওয়া থেকে সাবধানে উত্থপাগুলো প্লেটে সাজিয়ে রাখছে। অনিমা বিদ্যুত বেগে একটা গরম-গরম মুখে পুরে নিল।
–ও মাই গড!..তুমি এত সরঞ্জাম আনলে কখন?…চালগুড়ো তো আগের সপ্তাহ থেকে নেয়। কতদিন এই প্রিয় জিনিসটা খাইনি?
অনির্বান, অনিমার এই খুশির ছলছলে দুটো চোখের পানে তাকিয়ে পুরনো স্মৃতির ঢেউ-এ ভাসতে লাগল।
অনিমা ব্যাঙ্গালোরেই জন্মগ্রহণ করেছিল। ওখানেই পড়াশুনো করে বড় হয়েছে। ওর বাবা বিয়ে করেই ওর মাকে নিয়ে ওখানে চলে গেছিলেন। কম্পানির পার্মানেন্ট স্টাফ ছিলেন। পরে এক টুকরো জমি কিনে ছোট মত বাড়িও তৈরি করে ওখানেই থেকে গেছিলেন।
অনির্বানের সঙ্গেই অনিমা একটা অফিসে ব্যাঙ্গালোরে কাজ করত। অনির্বাণ এক বছর কাজ করার পরও জানতে পারেনি অনিমা একজন জন্মসুত্রে বাঙালি।
…একদিন অনিমা তার চেয়ারে বসে বিভোর হয়ে কানে স্পিকার গুঁজে গান শুনছিল। সেই গানের সুরটা মুখে আওড়াচ্ছিল।
অনির্বান চেনা একটা রবীন্দ্র সংগীতের সুর শুনতে পেয়ে, এদিক-ওদিক তাকাতেই অনিমাকে দেখতে পেয়েছিল। ব্রেক টাইম থাকাতে অনির্বান ও মন দিয়ে শুনছিল সেই সুর। হয়ত সেই সুরেই সেদিন দুটো অচেনা হৃদয় গাথা পড়েছিল।
তাই বাকিটুকু হতে বেশি সময় লাগে নি।
বিয়ে চুকে যাওয়ার কিছুদিন পরেই অনির্বানের ডাক কোলকাতায় পড়ল। অনিমাও সেদিন সাথে চলে এসেছিল। মাস তিনেক পর সেও একটা কম্পানিতে জয়েন করে নেয়।
..কোলকাতায় তার অসুবিধা বলতে সাউথের খাবারগুলো খুব মিস করে। নিজে বানানোর সময়ও পায় না। একমাত্র ছুটির দিন ছাড়া।
বাঙালি খাবারে এখনো পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারেনি।
আজ অনেকদিন পর নিজের পছন্দের খাবার পেয়ে আলু, ট্যমেটোর মশলা দিয়ে বেশ কয়েকটা সাবাড় করে দিয়ে বলে উঠল
—ভাবা যায় না। অনির্বান তুমি এসব খাবার তৈরি করতে কখন শিখলে?
অনির্বান মশলা মেখে আরো দুটো অনিমার প্লেটে দিয়ে বলল
–ব্যাঙ্গালোরে এমনি এতগুলো বছর কাটালাম?…অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম তোমাকে একদিন এই ল্যাঙড়া হাতের যাদু দেখাব।
–তোমার বাঁ হাতে সত্যি যাদু আছে।
অনির্বান এবার হুট করে বলে উঠল
–কটা খেলে একবার গুনলে?
–উহু
—দাঁড়াও দেখি।
অনিমা দাঁড়াতেই অনির্বান তাকে দুহাতে তুলে বলল
–অনেকটা ওজন বেড়েছে। এবার একটু অন্য কিছু খাবে নাকি?
অনিমা ব্যাঙের মত লাফ দিয়ে নেমে বলল
–কিচেনের ডাব্বাগুলোর দিকে তাকিয়েছ ভাল করে? ফর্দ করে রেখেছি। ডাইরির নিচে চাপা দেওয়া আছে। তাড়াতাড়ি জিনিসগুলো নিয়ে এস।..বাকি খাবারগুলো খাওয়ার অনেক সময় আছে।
অনির্বান দরজায় ঢোকার সাথে সাথেই খুব মন ভাল করার একটা মিষ্টি গন্ধ পেল। থলিটা নামিয়ে গন্ধ শুকে, শুকে কিচেনে ঢুকে পড়ল। চোখ মেলে তাকাতেই সে অবাক হয়ে পড়ল।
—অনিমা তুমি ঝিঙে পোস্তু রেঁধেছ?
–কেন?..একা তোমার মা-ই পারেন বুঝি?
–জাস্ট আই লাভ ইউ। তুমি এত সুন্দর বাঙালি রান্না শিখলে কোথায়?
–যেভাবে ভাষাটা শিখেছি?..আমার মা কখনো, সখনো রাঁধত। আমি মুখে তুলতাম না। এখন দেখছি পোস্তুর নেশা আমাকে মাতাল করে রেখেছে। কেনই বা করবেনা। বাঙালির ভালবাসাতেও পোস্তুর নেশাই থাকে। যে একবার মজেছে। আজীবন ঘোর কাটবে না।
অনির্বান হুট করে অনিমাকে পা দুটো ধরে বুকে তুলে বলল
–তাই!
অনিমা, নাকে নাক ঘষে বলে উঠল
–এবার ছাড়ো।না হলে তোমার থলিসুদ্ধ ইঁদুরে টেনে নিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ভরে রাখতে হবে।
অনির্বান মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠল
—ছিঃ…অভদ্র তুমিও। নিচে কিছু নেই মনে হচ্ছে।
অনিমা মুখে ডানহাত চেপে হাসতে, হাসতে পালিয়ে গেল। এই ফাকে অনির্বান কিছুটা ঝিঙে পোস্তু প্লেটে নিয়ে খেতে শুরু করল।