অলিম্পিক পুজো

চিন্ময় ভট্টাচার্য


মহালয়ার সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে আড়মোরা ভাঙতে ভাঙতে বাবুলদার মনে পড়ল পুজো এসে গেছে। তারপরেই মনে পড়ল তিনি পুজোর সেক্রেটারি। এরপর আর শুয়ে থাকা চলে না। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন বাবুলদা। এরপরেই সাজো সাজো রব পড়ে গেল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্লাবের মেম্বারদের ডেকে তুলে জরুরি বৈঠক হল। বাজারে বেরিয়ে দেখা গেল, ডেকরেটর কেষ্টদা মহালয়ার আগের দিন প্যাণ্ডেলের অর্ডার নিতে মোটেও রাজি হচ্ছেন না। অনেক চেয়ে চিন্তে কোনরকমে ফাটা বাঁশ, ছেঁড়া তেপ্পল, রং চটা কাপড় মিলল এবং তাই দিয়েই তড়িঘড়ি করে প্যাণ্ডেল হল। কুমোরটুলিতে প্রতিমার খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, সব প্রতিমা আগে থেকেই বুকিং হয়ে গেছে। শেষে অনেক ঘুরে হাতে পায়ে ধরে, বেশি টাকা দিয়ে প্রতিমা মিলল বটে, তবে ভাল পুরোহিত পাওয়া গেল না কিছুতেই। শেষে রিটায়ার করা সুন্দর ভট্টাচার্যকে মিলল এবং এভাবেই শেষ হল বাবুলদার দুর্গাপুজো। প্রতিমা নিরঞ্জন দিয়ে ফিরে এসে বাবুলদা সব মেম্বারকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন, সামনের বার এরকম হবে না। সব দেখে এবং শুনে তারক জেঠু মুচকি হেসে বললেন, প্রতিবারই তো প্রতিজ্ঞা হয়।

আসলে এবছর অলিম্পিকে ভারতীয় দলের ব্যর্থতা এবং তার পরের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখে আমার বাবুলদার পুজোর কথাই মনে পড়ে গেল। মনে হল কী আশ্চর্য মিল বাবুলদার পুজো আর ভারতীয় দলের প্রস্তুতিতে। এবারে রিওতে সবথেকে বড় ভারতীয় দল পদক এনেছে গতবারের থেকেও কম। সাকুল্যে একটি রূপো এবং একটি ব্রোঞ্জ। এবং অলিম্পিক হয়ে যাওয়ার পরেই সামনে আসছে, কত গাফিলতি ছিল ভারতীয় দলের প্রস্তুতিতে। তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তারা জানাচ্ছে পরিকল্পনা ঠিকঠাক হয় নি, পরিকল্পনার টাকা ঠিক পথে খরচ হয় নি। অনেক গাফিলতি, অনেক হতাশার মধ্যেও লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন ভারতের এই দুই কন্যা। তাই তাদেরকে নিয়ে চলছে আদিখ্যেতার পালা। সংবর্ধনা, পুরস্কারের পর পুরস্কার ঘোষণা, দেবতা জ্ঞানে পুজো করা, মাথায় তুলে নাচানাচির পালা অব্যাহত পুজোর মধ্যেও। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, চতুর্থ স্থানাধিকারী দীপা কর্মকার সংবর্ধনার বন্যায় অনুশীলন করতে পারছেন না ঠিক করে। আজ পশ্চিমবঙ্গে পুজো উদ্বোধন তো কাল ত্রিপুরায় সংবর্ধনার আয়োজন। প্রায় প্রতিযোগিতা চলছে দীপার সংবর্ধনা নিয়ে।

বাংলার বহু পুজো মণ্ডপে আলোকসজ্জায় সেজেছে ওদের কীর্তি। একই অবস্থা সিন্ধু এবং সাক্ষীর। অন্ধ্রপ্রদেশ নাকি তেলেঙ্গনা, সিন্ধু কোন রাজ্যের মেয়ে তাই নিয়ে দুই রাজ্য সরকারের মধ্যে চলছে কথার লড়াই। সংবর্ধনা দেওয়া, স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে কোন অন্যায় নেই, আমি তাতে হিংসেও করছি না। কিন্তু ঐ কথাটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে, সাফল্যের অনেক দাবীদার, ব্যর্থতার কোন বন্ধু নেই। এই মত আরও দৃঢ় হচ্ছে আপাত ছোট্ট একটি খবরে। সিন্ধুর এই বিরাট সাফল্যের পরেও অবহেলিত জুনিয়র শাটলাররা। প্রতিশ্রুতিমান ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়রা পরিকাঠামোর অভাবে যথা্যথ অনুশীলন করতে পারছেন না, তাদের দেখাশোনার কেউ নেই। অথচ ২০২০/ ২০২৪ সালে এরাই প্রতিনিধিত্ব করবে অলিম্পিকে। তখন ওদের ব্যর্থতার জন্যে অনেক সমালোচনা হবে। আর এদের মধ্যে আর একটা সিন্ধু পাওয়া গেলে সংবর্ধনার জন্যে শুরু হয়ে যাবে প্রতিযোগিতা। ২০২০ সালে অলিম্পিকে যাওয়ার আগে অনেক স্বপ্ন দেখানো হবে, প্রস্তুতি নিয়ে গালভরা অনেক কথা বলা হবে। তারপর ব্যর্থ হলে আবারও একটা তদন্ত কমিটি হবে, অনেক সুপারিশ হবে। যার একটাও মানবেন না কেউ।
বাবুলদার পুজো আর ভারতীয় দলের অলিম্পিক প্রস্তুতিতে খুব বেশি ফারাক আছে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two + four =