প্রাণ জুড়াবে পান্তুয়ায়
পলাশ মুখোপাধ্যায়
কোথাও যাওয়ার সঙ্গে খাওয়ার একটা নিবিড় যোগ আছে৷ যে কোন রসিক মানুষই তা মানবেন৷ তাই আমাদের এই বিভাগে আমরা বেড়ানোর পাশাপাশি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী৷ রূপসী বাংলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে অপরূপ নানা জায়গা, সঙ্গে রয়েছে সেই এলাকার নাম করা অপূর্ব স্বাদের নানা খাবারও৷ আমাদের অনেকেরই হয়ত সেই মনোলোভা খাদ্যবস্তু বা নয়নাভিরাম সেই স্থানের নাম অগোচরে৷ ”যাওয়া মানেই খাওয়া” বিভাগে থাকছে এমনই কিছু জায়গার হদিশ৷ এই সংখ্যায় আমাদের গন্তব্য পান্তুয়ার দেশ ”রানাঘাট”৷
মেঘলা মেঘলা দিনে ফুরফুরে মনে চড়ে বসলাম রানাঘাট লোকালে। সকাল সকাল ট্রেনে ভিড় তেমন নেই। কলকাতা থেকে ৭৪ কিলোমিটার, ঘন্টাদেড়েকের যাত্রাপথ। উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দারা বনগাঁ হয়েও যেতে পারেন রানাঘাট। শেষ সকালে যখন রানাঘাটে পৌঁছল ট্রেন তখন ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে শহরে। পুরনো বর্ধিষ্ণু শহর, খুব স্বাভাবিক ভাবেই গলি-ঘুঁজি, সংকীর্ণ রাস্তা-ঘাট। শিল্প সংস্কৃতি এবং আভিজাত্যের অনুরণন এখনও অনুভূত হয় এ শহরের আনাচে কানাচে।
ষ্টেশন থেকে বেরিয়েই আমাদের গন্তব্য ছিল আদর্শ হিন্দু হোটেল। কি ভাবছেন খুব খিদে পেয়েছে? খিদে যে পায়নি তা বলা যাচ্ছে না, তবে এই হোটেলে যাওয়ার অন্য একটা কারনও রয়েছে। শোনা যায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই হোটেলকে দেখেই নাকি ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নামে অসাধারণ সেই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। আমিও সেই রকমই জানতাম, তাই রানাঘাটে নেমেই ছুটেছিলাম অমর সেই উপন্যাসের আঁতুড় ঘরে।
গিয়ে কিন্তু একটু হতাশই হতে হল। হোটেলে ছিলেন বর্তমান কর্ণধারদের অন্যতম অমরনাথ কুণ্ডু। তিনিই জানালেন গোড়ার কথা। ১৯৬২ সাল নাগাদ গোপীনাথ কুণ্ডু এই হোটেল চালু করেন। এখন যেখানে হোটেল ঠিক তার পিছনে ছিল বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। সেখানেই সপরিবারে ভাড়া থাকতেন গোপীনাথ বাবু। সেই বাড়ির সামনেই হোটেল চালু করেন। বৈদ্যনাথ ছিলেন বিভূতি ভূষণের আত্মীয়। সেই সূত্রে বিভূতি ভূষণ মাঝে মধ্যেই আসতেন এই বাড়িতে। ব্যাস এর পর দুয়ে দুয়ে চার করে নিতে কারও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে আদর্শ হিন্দু হোটেল উপন্যাসটি এই হোটেল চালুর প্রায় ২০ বছর আগে লেখা। না, হোটেলের কর্ণধাররাও কিন্তু সে কথা অস্বীকার করেননি। তবে ব্যবসায়িক স্বার্থে তারা এই রটনায় বাধাও দেননি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, হাজারী ঠাকুর না থাকলেও এই হোটেলের খাবার কিন্তু যথেষ্ট সুস্বাদু এবং জনপ্রিয়, জানালেন এখানে খেতে আসা মানুষজনই।
এবার গন্তব্য পাল চৌধুরী বাড়ি। একটা টোটো গাড়ি নিয়ে নেওয়া হল। শহরের মধ্যে ঘুরতে বেশ সুবিধা। প্রায় ২৫০ বছর আগে অধুনা ঘটকপাড়া অঞ্চলে এই বাড়ি বানিয়ে ছিলেন কৃষ্ণ পান্তি। পর্ণ কুটিরে জন্মেও যিনি নিজের অধ্যবসায় এবং কর্ম দক্ষতার জোরে সম্পন্ন ব্যবসায়ী তথা জমিদার হয়েছিলেন। পরে পাল চৌধুরী উপাধি লাভ করেন। প্রায় ৩০০ ঘর বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়িকে ছোটখাটো প্রাসাদ বলা যায়। স্কটিশ স্থপতিদের দিয়ে বানানো এই বাড়ির মূল অংশ ছাড়াও মন্দির এবং উদ্যানে টেরা কোটার কাজ দেখার মত। যদিও বাড়ির সিংহভাগ অংশই এখন ভগ্নপ্রায়।
পাল চৌধুরীদের বাড়ি থেকে এবার পা বাড়ালাম চূর্ণী নদীর দিকে। বেশি নয় সামান্য হাঁটাপথ। মেঘলা দিনে চূর্ণীর ঘাটে বসে থাকতে বেশ লাগছিল। শহরের প্রায় ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়েছে নদী, মোটেই তেমন চওড়া নয়, কাজল কালো জলে পা ডুবিয়ে খানিক দুষ্টুমি করলেও বাধা দেওয়ার কেউ নেই। খানিক দূরে গিয়ে চূর্ণী মিশেছে গঙ্গার সঙ্গে।
এবার গন্তব্য সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। তবে তার আগেই পথে পড়ল নিস্তারিণী মন্দির। এই মন্দিরটিও বেশ সুন্দর। তবে বন্ধ থাকায় আমাদের এই মন্দিরে আর দেব দর্শন হয়ে উঠল না। এদিক ওদিক থেকে উঁকি ঝুঁকি মেরেই মন্দিরের বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে ফের টোটোয় চাপলাম।
শহরের প্রায় মধ্যভাগে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। এ অঞ্চলে খুব জাগ্রত এবং জনপ্রিয় হলেও মন্দিরের জায়গা খুবই কম। তাই মন্দিরের সামনে গাড়ি রাখার জায়গাটুকুও নেই। তবে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে মনটা ভালো হয়ে যায়। ভক্তি এবং সংস্কার ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। যাদের দেবদ্বিজে ভক্তি আছে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির তাদের ভাল লাগবে।
হাতে বেশ খানিকটা সময় ছিল, দুপুর দুপুর সোজা চলে গেলাম বেগোপাড়া চার্চে। শহর থেকে বেশ একটু দূরে হওয়ায় এই চার্চটিতে জনসমাগম উৎসবের সময় ছাড়া খুব বেশি হয় না। চার্চটি কিন্তু বেশ সুন্দর। খ্যাতিতে, জনপ্রিয়তায় এবং সৌন্দর্যে ব্যান্ডেল চার্চের পরেই নাকি এই চার্চের স্থান। সুন্দর পরিবেশে চার্চটির ভিতরের কারুকাজও দেখবার মত। খানিক সময় কাটিয়ে বিকেলের দিকে ফের রানাঘাট শহরে।
এবার যে উদ্দেশে এখানে আসা সেই পান্তুয়া অভিযানের পালা। রানাঘাট তার পান্তুয়ার জন্য বিখ্যাত। ছানা থেকে তৈরি এই বিখ্যাত মিষ্টির ইতিহাস পাওয়া খুব কঠিন। প্রায় কেউই ঠিকঠাক বলতে পারলেন না। তবে বহু বিখ্যাত পান্তুয়া প্রস্তুতকারকের নাম উঠে এল।
পান্তুয়া প্রস্তুত কারক হিসাবে যার নাম সর্বাগ্রে আসে তিনি জগু ময়রা। জগু ময়রার আসল নাম যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিক। তারই বংশ পরম্পরায় এখনও পান্তুয়া প্রস্তুত করে চলেছেন প্রামাণিকরা। পান্তুয়াকে আরও বিখ্যাত করেন প্রভাত প্রামানিক, ১৯২০ সাল নাগাদ। পাশাপাশি বিখ্যাত ছিল হরিদাস পালের পান্তুয়াও। জগু ময়রার নামে সেই দোকান আজও আছে।
এখনও প্রামাণিকদের তিনটি দোকানে পান্তুয়া বিখ্যাত। বড়দা মেজদা এবং ছোড়দার দোকান বলেই শহবাসী চেনেন এই দোকানগুলিকে। পান্তুয়া মেলে অন্যান্য মিষ্টির দোকানেও। খানিকটা ল্যাংচার মত দেখতে হলেও স্বাদ কিন্তু অনেকটাই আলাদা। সামান্য একটু শক্তও। ভোলানাথ প্রামাণিক জানালেন সামান্য শক্ত না হলে নাকি স্বাদটা তেমন খোলে না, তাই পান্তুয়ার উপরের অংশকে একটু শক্ত রাখা হয়।
নিয়ে নেওয়া হল বেশ খানিকটা পান্তুয়া। এবার বাড়ি ফেরার পালা। দিনভর ঘোরাঘুরি করে বেজায় ক্লান্ত শরীর। তাই ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা রানাঘাট লোকালে উঠে পড়লাম। ট্রেন ছাড়তেই সন্ধের হালকা বাতাস গায়ে মুখে। বড় ভাল লাগল। খুলে বসলাম সঙ্গে থাকা একটা গল্পের বই। ঘন্টা দেড়েক নিশ্চিন্ত।