বোধোদয়
অমল দাস
সে’বার দুপুরে খাওয়ার টেবিলে রতনলাল বাবু বলে ওঠে –“বাবা আমি ভাবছি আমাদের পিছনের ওই একচালা ঘরটায় আমার শেষ জীবনটা কাটাই তুমি আপত্তি করনা যেন”।
-না…বাবা! এত বড় দোতলা বাড়ি পাঁচটা রুম, তুমি ওই ঘরটায় কেন থাকবে? না তা হয় না তুমি এখানেই থাক।
অজয়ের এই কথায় পাশে বসা সুমেঘার মুখমণ্ডলে এক বিরক্তির আভাস জেগে ওঠে যা অজয় বা রতনলাল বাবু কেউই খেয়াল করেনি।
রতনলাল বাবু আবেগতাড়িত হয়ে বলে ওঠেন – “না অজয়! ওই ঘরটায় তোমার মায়ের অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে। এমন কি তোমার শৈশবের স্মৃতিও। তাই শেষ সময়ে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি মন্থন করেই দিন কাটাতে চাই। তুমি আর না কোরো না”।
-না বাবা তা কখনই হয়না! তুমি এ ঘরেই……
অজয়ের কথা শেষ না হতেই মুখের কথা টেনে নিয়ে সুমেঘা বলে ওঠে-“ বাবা যদি থাকতে চায় ওখানে থাক না। তুমি মানা কোরো না। ওটা তো এই বাড়িরই অংশ ! দূরে তো আর যাচ্ছেনা”?
সুমেঘার মিছরির ছুরিতে যে কি ধার ছিল তা অজয় বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারল না। সে শুধু বলেছিল “ঠিক আছে যা ভালো হয় কর”।
অজয় সাহা ভারতীয় নৌ বাহিনীর একজন দক্ষ নাবিক। তার বছরের অধিকাংশ সময় এদেশ সেদেশের সমুদ্রেই দিন কেটে যায়। ন মাসে ছ মাসে তার একবার বাড়িতে আসা যাওয়া । ছুটিতে যখন কলকাতার বাড়িতে ফেরে তখন স্ত্রী সুমেঘা ও বছর ছয়ের পুত্র দেবাঞ্জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যায়, কখন পাহাড় কখন সমুদ্র তো কখন বিদেশ ভ্রমণ। পিতা রতনলাল সাহাকে প্রতিবারই অনুরোধ করা হয় কিন্তু তিনি জানিয়ে দেন “বাবা তোমরা যাও আমার বয়স হয়েছে, যাতায়াতের ধকল আমার সইবে না, তাছাড়া এই শহরে ফাকা বাড়ি রাখাও তো যায় না! তোমরা যাও, আমায় নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা”। পিতার এই কথায় পুত্র আর তেমন জোর দিত না। তবে অজয় পিতা কে যথেষ্ট মান্যতা দেয় তা নিয়ে কোন সংশয় নেই।
সুমেঘা প্রচণ্ড আত্মঅহংকারী মহিলা পিতার একমাত্র কন্যা হওয়ার দৌলতে শৈশব থেকেই তার অহং ভাব নিম্নচাপ মেঘের মত ছড়াতে থাকে। আর নৌবাহিনীর নাবিক স্বামী হওয়ায় সেই অহং প্রবল ঘূর্ণির আকার নেয়। তার আভিজাত্য দম্ভ এত বেশি যে মানুষ কে মানুষ গণ্য করতেও দ্বিধা । তার এই ঔদ্ধত্যের ফলেই রতনলাল বাবু একচালা ঘরে আশ্রয় নিতে বাধ্য। সেকেলে আদপকায়দার রতন বাবুকে তার সহ্য হয়না। তাঁর উপস্থিতি বন্ধু মাঝে বিরক্তি দেয় । সে পার্টি, রেস্তরাঁ, নাইট ক্লাবে অভ্যস্ত। বান্ধবীদেরদের নিয়ে বাড়ীতেই তাসের আসর, আর সেখানে কম বেশি টাকা পয়সারও হিসাব হয়। পুত্রকে নামকরা ইংরাজি মধ্যমে ভর্তি করেছে কিন্তু সেদিকে তার বিশেষ চোখ নেই। বাড়িতে কাজের মাসি আছে সেই রান্না করে। শশুরমশাই খেল কি না খেল তাতে তার কিচ্ছু যায় আসেনা। শশুরমশাই যদি মাঝে মাঝে ছোট্ট দেবাঞ্জনকে আদর্শলিপি পড়ান তাতেও তার প্রচণ্ড এলার্জি। কারন বান্ধবীদের মাঝে তাকে হেনস্থা হতে হয়।
এই তো সেদিন সকলে মিলে তাসের আসরে মশগুল। হটাৎ সিক্তা দেবাঞ্জনকে ডেকে ফ্রীজ থেকে জলের বোতল আনতে বললে সঙ্গে সঙ্গে দেবাঞ্জন বলে ওঠে আন্টি -“আ- তে কি হয় বলতো”?
-কি হয় দেবা সোনা ?
-‘আ’ তে আলস্য দোষের আকর।
রিনা পাস থেকে বলে ওঠে “আরে সুমেঘা! তোমার ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়েছ না? এই সব মান্ধাত্তার আমলের ট্রিপিক্যাল শব্দ কোথায় পেল”?
রিনা ভুলেই গেছে ও যে কথা বলেছে তার অধিকাংশই বাংলা। আর স্বামীর বকা শুনে যখন রাতে বালিশ চাপা দিয়ে ফোঁপরে ফোঁপরে কাঁদে সেটাও বাংলায় হয় ইংরাজিতে নয়। রক্ষা এখানেই যে বন্ধ ঘরের সে অভিনয় তো আর কারো চোখে পড়েনা।
রিমার কথা সুমেঘার ইগোতে লাগে, সে দেবাঞ্জনকে বকা দিলে সেও পাল্টা দিতে শুরু করে “অ- অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর” বলতে বলতে ছুটে পালায়।
সে হয়তো অনেক ছোট কিন্তু ঠাকুরদা তাকে একটু একটু করে ভালো মন্দটা শেখাতে শুরু করেছে এটা তারই ফল। শিশুর প্রাথমিক মনস্তত্ত্বের বিকাশ তো পরিবার থেকেই শুরু সেই দায়িত্বটা রতনলাল বাবুই নিয়েছেন।
কাজের সুত্রে শহরে এসে রতনলাল বাবু ভাড়া বাড়িতে থেকে ধীরে ধীরে ওই একচালা ঘরটি তৈরি করেন। এর পর কঠোর পরিশ্রম আর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির কারনে ওই দোতলা বাড়িটি তৈরি করেন। পুত্রকে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। গিন্নি অলকাকে সুখে দুঃখে সর্বদা সঙ্গে পেয়েছেন। শত কষ্টেও খুশি থাকার রাখার চেষ্টা করেছেন। সে সব আজ অতীতের আচ্ছাদনে ঢাকা। এই কষ্ট ভোগের বিন্দু মাত্রও তো সুমেঘার পাতে পড়েনি কখন। অথচ এই বাড়িতে তার দখলদারি। রতনলাল বাবু তার নির্মিত বাড়িতেই অসহনীয়। পুত্র কে তিনি কখনই সুমেঘা সম্পর্কে কোন অভিযোগ করেন নি কারন পাছে পুত্র কষ্ট না পায়।
ওই একচালা ঘরটায় অলকার অনেক স্মৃতি। এই ঘরেই সে প্রথম বধূ হয়ে পা রেখেছিল। ফুলশয্যার রাতে আরশোলা দেখে চিৎকার করে লোক জড়ো করে ফেলছিল। এই ঘরেই সে মাতৃত্বের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ছিল। অজয়ের জন্মও এখানেই। বছর দশেক আগে ইহলোক ত্যাগের আগে অলকা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল-“আমার জন্য যদি কিছু রাখো তবে ওই একচালাতেই রেখো”।
তাঁর একটা বড় ছবিও এখানে রাখা আছে। ওই ছবিই রতনলাল বাবুর নিঃসঙ্গতার সাথী। তিনি গিন্নির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনের অনেক কথা বলেন যা অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারেনা। তিনি অলকাকে বলে-“তুমি যেন সুমেঘার ওপর রাগ করোনা ও ছোট এখনো। একদিন নিজে থেকেই সব বুঝবে”।
দোতলার খিড়কী থেকে দেবাঞ্জনকে ঠাকুরদাদার ঘরে যেতে দেখে দেবা দেবা করে চিৎকার করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গুরুতর আঘাত পায় সুমেঘা। মাথায় চোট লাগায় রক্ত ঝরতে থাকে। রতনলাল বাবু দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মায়ের ওই অবস্থা দেখে ছোট্ট দেবাঞ্জন কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাকে কাজের মাসিই সামাল দেয়। প্রচণ্ড রক্ত ক্ষরণের কারনে ডাক্তার দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে বললেন। সুমেঘার পিতা মাতাও ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। কিন্তু তাদের রক্তের যে গ্রুপ তার সাথে সুমেঘার রক্তের মিল নেই। তার রক্তের গ্রুপ হল বিরল গোত্রের “মুম্বাই ব্লাড গ্রুপ”। যা সারা ভারতে হাতে গোনা কয়েকটি মানুষের শরীরে রয়েছে। অগত্যা চিন্তার ভাঁজ সকলের কপালে।
যতদূর পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল সব জায়গাতেই সুমেঘার পিতা প্রদ্যুত ব্যানার্জী চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোনোরকম সাড়া মেলেনি। ডাক্তার মুম্বাইয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘থিঙ্ক ফাউন্ডেশন’-এর কথা বলেন যারা এই রক্ত সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু সেখান থেকে রক্ত আনতে গেলে দেরি হওয়ার প্রচণ্ড ভয়। তবু একজন কর্মী কে প্রদ্যুত বাবু মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে পাঠান।
হটাৎ রতনলাল বাবুর মনে পড়ে তার রক্তও নাকি খুব দামী। কারন ওনার ছোট বেলায় শরীর খারাপের সময় কোন এক ডাক্তার সাবধানে থাকতে বলেছেন। তিনি ডাক্তারকে তার রক্ত পরীক্ষার কথা বলেন। আর আশ্চর্যজনক ভাবেই সুমেঘার রক্তের সাথে রতনলাল বাবুর রক্ত মিলে যায়। সুতরাং আর দেরি কীসের।
কিন্তু ভয় আছে উনি বয়স্ক মানুষ বেশি রক্ত নেওয়া যাবেনা। অন্য বিপদ হতে পারে। তাতে কি! তিনি নির্ভীক বৌমাকে যে করেই হোক সুস্থ করতে হবে। পিছপা হলে চলবে না। যদি প্রাণও যায় যাক সে ভয় নেই তাঁর। ছোট্ট দেবাঞ্জন যেন কোন ভাবেই মাতৃ হারা না হয়। ডাক্তার পাশেই একটা বেডে রেখে রক্ত সংগ্রহ করতে লাগে এবং একই সঙ্গে দুজনকেই নিরীক্ষণ করতে থাকে, বিশেষ করে রতনলাল বাবুকে একটু বেশি, কারন তিনি যেন বেশি দুর্বল না হয়ে পড়েন।
কিচ্ছুক্ষন পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে সুমেঘা চোখ খোলে। মাথায় ব্যান্ডেজ। পাশে মা বিন্দুদেবী আর পিতা প্রদ্যুতবাবু দাঁড়িয়ে। মা সুমেঘার মাথায় হাত রেখে বলে ওঠে “চিন্তা করিস না ভালো হয়ে যাবি খুব শীঘ্রই। ধন্য তোর শশুরমশাই, উনি না থাকলে আজ হয়তো একটা বিপদ হয়ে যেতে পারতো”।
মায়ের কথা শুনে চোখ ঘোরাতেই পাশের বেডে শশুরমশাইকে দেখে পলকহীন ভাবে চেয়ে থাকে। আবেগ ধরে না রাখতে পেরে সে নিজ মনে অনুশোচনায় পড়ে ভাবতে লাগে “মানুষটি কতই না মাটির মানুষ। কত তাচ্ছিল্য কত অবহেলা করেছি, কখনও বিন্দু মাত্র প্রতিবাদ করেননি, আজ বিপদের দিনেও উনি আমাকে চাইলে দূরে ঠেলে দিতে পারতেন কিন্তু তা করেননি বরং প্রাণদাতা হয়ে এগিয়ে এসেছেন নির্দ্বিধায়। যে অন্যায় করেছি তার কি ক্ষমা আছে? তার কি প্রায়শ্চিত্ত আছে? থাকলে আপনি আমায় মাফ করুন বাবা …..”। এই ভাবনার মধ্যেই সুমেঘার দু চোখ বেয়ে জল নেমে আসছে। আর তাতে তার জমে থাকা অহং দম্ভ ধুয়ে ধুয়ে বেরিয়ে পড়ছে । সারা মুখমণ্ডলে এক আত্মগ্লানির ছাপ ফুটে উঠেছে, যাকে পরিমাপ করা বা অনুধাবন করার ক্ষমতা হয়ত অন্য কারোর নেই। হয়ত সম্ভবও নয়।