নারী-পণ্য-ভোগ্য-বিকিকিনি
ইরাবতী
নারী শব্দের প্রতিশব্দ নিয়ে চর্চা করলে স্বভাবতই আমাদের মনে আসে মহিলা,মেয়ে,কন্যা এমনই আরও অনেক শব্দ। কিন্তু,বছর চারেক আগে রাজধানী দিল্লির এক হিমেল রাত নারীকে আরও এক অন্য নামে পরিচিতি দিল। সাংবাদিক হওয়ার সুবাদেই হোক বা বাধ্যবাধকতায়, আমার জীবনে সেই রাত ছিল অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের এবং অবশ্যই সাংবাদিকের কর্তব্য পালনের। কুয়াশাঘন অন্ধকারে নয়াদিল্লির কমলাবাঈ মার্কেটের অদূরে কাচ ঢাকা গাড়িতে বসে হাড় হিম করা ঠাণ্ডাতেও উত্তেজনায় ঘেমে উঠেছি। আমি সেদিন সঙ্গী হয়েছিলাম এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিশেষ অভিযানের। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর তাঁরা আমাকে তাদের অপারেশনের সঙ্গী হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। পাখি পড়ার মতো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন আমার কাজ শুধুই গাড়ীতে বসে যা হতে চলেছে দেখা। কোনও রকম মুভমেন্ট নৈব নৈব চ। সেই রাতে তাঁদের লক্ষ্য ছিল নারী পাচার রোখা এবং পাচারকারীদের বমাল সমেত পাকড়াও করা।
সাংবাদিকতার সূত্রেই এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে পরিচয়। এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক সুবীর রায়। তাঁর মুখ থেকেই একাধিকবার নারী পাচার রোধের রোমহর্ষক কাহিনী শোনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাচার হয়ে যাওয়া মহিলাদের উদ্ধারে পুলিশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে তারা সেই ২০০১ থেকে। আগ্রহ হয় জানতে, কিভাবে তাঁরা কাজ করেন,কিভাবে ধাপে ধাপে পৌঁছে যান লক্ষ্যে এবং অবশেষে উদ্ধার করতে সক্ষম হন আধাঁরে তলিয়ে যাওয়া সেই মহিলাদের। সচক্ষে তাদের এই কাজ প্রত্যক্ষ করতে সেই রাতে সুবীরবাবুদের সঙ্গী হয়ে নারীকে অন্য এক নামে পরিচিত হতে শুনলাম। হিন্দিতে ‘সামান’ শব্দের অর্থ বস্তু বা পণ্য। আর নারীকে ঠিক এই শব্দেই পরিচিত হতে শুনে মনে মনে শিউরে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিল,আমিও তো এক মেয়ে। তাহলে আমিও কি ‘সামান’? মেয়ে মানেই কি ভোগের বস্তু,ব্যবহারের পণ্য? সেই রাতে নারী পাচারকারীদের বমাল পাকড়াও করতে সুবীরবাবু এবং তার সঙ্গীরা পূর্বপরিকল্পনা মতো দালালের ভেক ধরেছিলেন। অর্থাৎ, একদল দালালকে ধরতে তাদের সঙ্গে ‘ডিল’ আরেক দালাল দলের। আর সেই লেনদেনের মাঝেই আসল অপরাধীদের হাতেনাতে ধরার পরিকল্পনা। আর চারপাশে সাদা পোশাকে ওত পেতে ছিল দিল্লি পুলিশের বিশেষ দল।
যে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে সেদিনের অভিযান, সেই নাবালিকার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। ফোনের কথোপকথনে জানতে পারি,পাচারকারীরা লেনদেনের শেষে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে তুলে দেবে মেয়েটিকে। যে কোনও মুহূর্তে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারে,এই আশঙ্কায় পাচারকারীরাও পা ফেলে বুঝেশুনে। তাই অল্পসময়েই তারা দু’দুবার পাল্টেছে তাদের ‘সামান’ হ্যান্ডওভার করার সময় আর জায়গা। বাজিয়ে দেখে নিতে চায় সত্যিই ‘ডিল’ হবে কিনা। অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে সুবীরবাবু আর তার সঙ্গীরাও কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত ভোর চারটে নাগাদ মেয়েটিকে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় আসতে রাজী হয় পাচারকারীরা। ঘড়ির কাঁটা যেন সরতেই চায় না। উত্তেজনায় আর ধৈর্য রাখতে না পেরে বার বার জানতে চাইছি ঠিক কি ঘটতে চলেছে, আর বার বারই উত্তর পেয়েছি ধৈর্য রাখুন। অবশেষে এক সময়ে অন্ধকারের আড়াল থেকে সামনে এল ছায়ামূর্তিরা। টানটান উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। ইতিমধ্যেই বার্তা পৌঁছে গেছে দিল্লি পুলিশের বিশেষ বাহিনীর কাছে। তারা তৈরি। গাড়ি থেকে নেমে ছায়ামূর্তিদের দিকে এগোতে থাকলেন সুবীরবাবু আর তার সঙ্গীরা। বিপদের সম্ভাবনা প্রবল। তাই নির্দেশ অনুসারে গাড়িতে বসেই কুয়াশা ভেদ করে যতদূর চোখ যায় দেখতে চেষ্টা করা ঠিক কি ঘটছে।
এরপরেই মিনিট দুয়েকের স্তব্ধতা। তারপরেই চিৎকার, ভারী বুটের শব্দ আর পুলিশ জিপের সাইরেনের মর্মভেদী আওয়াজ। যতদূর চোখ যায়, বুঝলাম ধরা পড়েছে অভিযুক্তদের কয়েকজন। বাকীদের পিছনে ধাওয়া করেছে পুলিশ। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে অপহৃত নাবালিকাকে। তবে, বিগত বেশ কয়েকদিনের অত্যাচার আর এদিনের এই অপারেশনের আকস্মিকতায় বাকহারা মেয়েটি। গ্রামেরই এক তরুণের কথায় ভুলে তার সঙ্গে ঘর ছেড়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল কানাগলির আঁধারে। উদ্ধার হওয়ার পরও তাই বিশ্বাস করতে পারছিল না, সত্যিই মুক্তি পেয়েছে সে।
এরকমই একাধিক অপারেশনের প্রতি মুহূর্তের খবর পেয়েছি সুবীরবাবুর মুখে। ২০১১ সালের এমনই এক সপ্তাহান্তের শীতের রাতের কথা আবারও মনে পড়েছিল এই সূত্রে। রাজধানী দিল্লির তাপমাত্রায় তাপ শব্দটা যোগ না করলেই ভাল। সেই রবিবার দুপুরেই জানতে পেরেছিলাম সিআইডি ইন্সপেক্টর সর্বাণী ভট্টাচার্য এসেছেন দিল্লিতে। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি-র বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার সর্বাণীদিকে বিশেষ বিশেষ অপারেশনের দায়িত্বে পাঠানো হয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে সর্বাণীদির দিল্লি আগমণ। সুবীরবাবুর কাছেই খবর পেলাম সর্বাণীদির এদিনের অভিযান নয়াদিল্লির তুঘলকাবাদ এক্সটেন্সন এলাকার এক বস্তি। যেখানে দিনের আলোতে ঢুকলেও রাস্তা চিনে বেরিয়ে আসতে পারলে আপনার প্রখর স্মৃতিশক্তির তারিফ করতেই হবে। এমনই এক কানাগলিতে দুধের শিশুসহ হারিয়ে গিয়েছিলেন এক মহিলা। স্বামী পরিত্যক্তা এই মহিলাকে কাজের লোভ দেখিয়ে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে তার শিশুসহ পাচার করে দেওয়ার ছক কষেছিল পাচারকারীরা। সন্তানসহ তুঘলকাবাদ এক্সটেন্সনের এই কানা গলিতে এসে পড়ার পর আসল উদ্দেশ্য জানতে পারেন তিনি। বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে পালাতে পারবেন না বুঝতে পেরে একাই সুযোগ বুঝে পালান তিনি। কোনমতে যোগাযোগ করেন বাড়ির সঙ্গে। কিন্তু সন্তানকে ফেলে আসার শোক ভুলতে পারেননি। কলকাতায় ফিরে আসার পরই তার মনে হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছতেই হবে তাকে। তার সন্তানকে একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীই উদ্ধার করতে পারেন। হাঁটতে হাঁটতে সেই মহিলা যখন মহাকরণের সামনে পৌঁছান, দীর্ঘ কয়েকদিনের শারীরিক-মানসিক ধকলের চোটে সামনের ফুটপাথেই জ্ঞান হারান তিনি। মহাকরণ প্রহরারত পুলিশকর্মীরা কোনও মতে তার কথা জানতে পারেন এবং তাদের সাহায্যেই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছয়। মুখ্যমন্ত্রীর জরুরি নির্দেশেই সিআইডি ইন্সপেক্টর সর্বাণী ভট্টাচার্যের বিশেষ অভিযানে দিল্লি আসা এবং মুখ্য উদ্দেশ্য, সেই শিশুটিকে উদ্ধার করে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া। অভিযান শেষে সর্বাণীদি বঙ্গভবনে ফিরবেন জেনে, সেখানেই মিডিয়া সেন্টারে ঘাঁটি গাড়লাম সন্ধে থেকে। তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে, বসে থাকতে থাকতে চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎই পুলিশের গাড়ির শব্দে চোখ খুলে দেখি গাড়ি থেকে নামছেন সর্বাণীদি। সঙ্গে সস্তার শালে মুখ ঢেকে বছর তিরিশ-পঁয়ত্রিশের এক মহিলা এবং তার কোলে এক দুধের শিশু ঘুমে অচেতন। এরপর সর্বাণীদির মুখেই শুনলাম, কিভাবে দিল্লি পুলিশের বিশেষ বাহিনীর সাহায্যে সর্বাণীদি এবং তার সহযোগী উদ্ধার করেছেন শিশুটিকে। প্রাণ বাজী রেখে পাচারকারী মাফিয়া ডেরা থেকে শিশু উদ্ধারের রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ ব্যুরো চিফকে জানিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম যখন, সময়ের হিসেবে ভোর হয়ে গেলেও নিকষ কালো আঁধারে তখনও ডুবে রাজধানী দিল্লি।
সুবীরবাবুর সঙ্গে কথায় জানতে পারি, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১২ সালের সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ এবং লাগোয়া বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের সীমানা লাগোয়া একাধিক জেলা থেকে একের পর এক মহিলা, শিশু, কিশোরী পাচার হয়ে যাচ্ছে ভিন রাজ্যে। দিল্লি হয়ে তারা আবার পাচার হয়ে যায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। কখনো কাজের, কখনো বিয়ের, কখনো অন্য কোন ছলনায় ভুলিয়ে বা সরাসরি অপহরণ করে মেয়েদের এইভাবেই পাচার করে লেনদেন চলছে মোটা অঙ্কের টাকার। একবার দালাল বা আড়কাঠিদের খপ্পরে পড়ে গেলে আমাদেরই বাড়ীর মেয়ে, বৌ, বোনেরা হয়ে যায় ‘সামান’। মোটা টাকা উপার্জনের উপায়। মেয়েদের লুকিয়ে রাখার জন্য তৈরী হয় গোপন ডেরা, অন্ধকার কুঠুরি। পরে সেখান থেকেই সুযোগ বুঝে পাচার করা হয় কখনো সড়ক, কখনো জলপথ আবার কখনো রেলপথ দিয়ে। পণ্যের মালিকানা বদল হয়ে এক হাত থেকে অন্য হাত ঘুরে মেয়েটি আমার-আপনার পরিচিত মুখ আর থাকে না। লালসার কানা গলিতে ঘুরতে ঘুরতে সেই ঘরের মেয়েই হয়ে যায় ‘দুসরি অওরত’।