অ-বলা

নবনীতা দাস, রঘুনাথগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ

এলার্মটা বেজে উঠলো ঠিক সকাল সাড়ে পাঁচটায়। প্রতিদিন এই সময় ঘুম থেকে উঠে যাওয়াই আমার অভ্যেস। তারপর প্রাতঃকৃত্য সেরেই বেড়িয়ে পড়ি কুট্টুসকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে। তারপর ঘরে এসে খবরের কাগজটাতে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জন্য চোখ বোলাতে বোলাতে বাজে সকাল আটটা। তার মধ্যেই মাসি এসে রোজকার কাজকর্ম সেরে নিয়ে রান্নায় বসে যায়। একলা মানুষ আমি। বিয়ে করাটা এখনো হয়ে ওঠেনি। যৌবনটা কেটে গেছে ছাত্রজীবনের প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায়। তারপর যখন কোনোক্রমে একটা চাকরি জুটলো তখন বোনের বিয়ে দিতে ও বাড়ির স্বচ্ছলতা বৃদ্ধিতে বাকি সময়টাও কেটে গেল। এখন যদিও বিয়েটা করে নেওয়াই যায়। কিন্তু একাকিত্বের এই জীবনটার উপর বড় মায়া পড়ে গেছে যেন। বন্ধুবান্ধবের বিয়ের নিমন্ত্রনে গিয়ে কখনো কখনো মনে হয় ঠিকই যে এবার বিয়েটা করেই নিই, কিন্তু বিয়েবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরে আরাম করে যখন গল্পের বইটা নিয়ে বসি তখন মনে হয়, নাহ এই বেশ ভালো আছি। সঙ্গী হিসেবে বউয়ের চেয়ে বইটাই আমার বেশি প্রিয়। তাছাড়া কুট্টুস যেন একাকিত্বের দুঃখ যা একটু অবশিষ্ট ছিল তা পুরোপুরিই কাটিয়ে দিয়েছে। ওহ, কুট্টুসের তো পরিচয় দেওয়াই হয়নি। কুট্টুস আমার পোষ্য একটি দেশী কুকুর। ওকে নাওয়াতে খাওয়াতে ঘোরাতে আমার অবসর সময়গুলো ভালোই কেটে যায়। চাকরি সূত্রে আমাকে কলকাতায় চলে আসতে হয় প্রায় দশ বছর আগে। মা বাবাকে অনেক পীড়াপীড়ি করেও গ্রাম ছেড়ে শহরে আনতে পারিনি। এখন তো আবার অন্য সুর ধরেছে মা। যখনই কলকাতা চলে আসতে বলি তখনই বলে বাড়িতে বউ আনলে তবে আসবে, নয়তো না। তাই আমার সংসার কুট্টুস ও আমাকে নিয়েই, আর সঙ্গে কয়েকটি গল্পের বই।

আজ রবিবার। তাই আমার অফিস যথারীতি ছুটি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই শিবালিকের আমার বাড়িতে আসার কথা তার নববিবাহিতা বউকে নিয়ে। ওর বউও চাকুরে, তাই তিনজনের ছুটি-ছাটা, সুবিধা-অসুবিধা সব ভেবে-চিন্তে আজ শেষেমেস তারা আসছে। শিবালিকের বসবাস কল্যানীতে। আজকের মধ্যাহ্নভোজটা তারা এখানেই সারবে এবং সন্ধের মধ্যে আবার ফিরে যাবে। তাই মাসি গতানুগতিক খাদ্যসূচিগুলোর আয়োজন করলেও মুর্গিটা আজ আমিই রাধবো ঠিক করেছি। বন্ধুদের মধ্যে এবং অন্যান্য পরিচিত মহলে রান্না নিয়ে আমার একটা নাম ডাক আছে বরাবরই। তাই কেউ আমার বাড়ি এলে অন্তত একটা পদ আমাকে রাঁধতেই হয়। রান্নাবাটি শেষ হয়ে গেছিল বারোটার মধ্যেই। শিবালিকরাও ঢুকে পড়ল সাড়ে বারোটার দিকে। দেড়টার মধ্যে খেতেও বসে গেলাম সকলে। বৌদি অসম্ভব মিশুকে ও মিষ্টভাষী। আমি একা মানুষ তাই সেও হাত লাগলো। কুট্টুস নতুন মানুষ দেখে তো আনন্দে আত্মহারা। প্রথমটা একটু চেঁচামেচি করলেও এখন বেশ ওদের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খেতে বসে একথা ওকথা বলতে বলতে বৌদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “একটা কথা অনেকক্ষন ধরে জিজ্ঞেস করবে ভাবছিলাম, সুযোগ হচ্ছিল না। তোমার এই কুট্টুসের পেটের দিকটাতে অমন বীভৎস দাগটা কিসের! কোনো চর্মরোগ নাকি?” এই প্রশ্নটা যদিও অধিকাংশ মানুষই করে থাকে কুট্টুসকে দেখে। তাই আমি হেসে বললাম,”চিন্তা করো না, আর যাই হোক চর্মরোগ নয়।” “তবে এমন দাগ একটা পোষা কুকুরের গায়ে হলো কেমন করে! কোনো দুর্ঘটনা হয়েছিল বুঝি?” শিবালিক মুরগির ঠ্যাংটায় কামড় দিতে দিতে অবাক স্বরে বলে উঠলো। সেই কলেজ জীবন থেকেই দেখে আসছি, শিবালিক মুরগির ঠ্যাং খেতে খুব ভালোবাসে। তাই আমি মাংসের হাড়িটা থেকে আরেকটা মুরগির ঠ্যাং খুঁজে বের করে ওকে দিতে দিতে উত্তর করলাম, “এর পিছনে একটা ছোট গল্প আছে, খেয়ে ওঠ, বলছি।” খাওয়া দাওয়া সেরে, সব গুছিয়ে বসতে বাজলো প্রায় দুপুর আড়াইটা। আর কোনো কাজ নেই, এবার স্রেফ আড্ডা। জোয়ানের কৌটোটা হাতে নিয়ে বসে প্রথমেই বৌদি কথাটা আবার তুললো, “কিগো এবার বলো তোমার গল্প, শুনি।” আমিও একটু জোয়ান কৌটো থেকে তুলে নিয়ে মুখে ফেলে শুরু করলাম।

“আমি তখন এপাড়ায় নতুন এসেছি এই বাড়িটা কিনে। তার আগে থাকতাম ভাড়া বাড়িতে। একা মানুষ, কাউকে চিনতামও না ঠিকঠাক তখন এ পাড়ায়। একাকিত্ব যাতে অনুভব না করি তাই বরাবরই আমি আমার জীবনটাকে একটা নির্দিষ্ট রুটিনে বেঁধে রাখি। প্রাতঃভ্রমনটাও সেই প্রথম জীবন থেকেই চালিয়ে আসছি। রোজ সকালে এই সামনের রাস্তাটা দিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে একটা বড় মাঠে আমি পায়চারী করতাম, আজও করি। এই রাস্তাতেই একদিন আপন মনে হেটে যাচ্ছি। ছোট থেকেই তো আমার একটু অন্যমনস্ক থাকা অভ্যেস, জানিস হয়তো। হঠাৎ আমার সামনে থেকে একটা কুকুর প্রায় তেড়ে এলো চিল চিৎকার করতে করতে। কুকুর প্রীতি আলাদা করে আমার কোনোদিনই ছিল না। বরং এই রাস্তার কুকুরগুলো থেকে আমি একটু দূরে দূরেই চলার চেষ্টা করতাম আজীবন। কুকুরটার অমন ধেয়ে আসা দেখে আমি ভয়ে চার পা পিছিয়ে গেলাম। আজ আমার আর নিস্তার নেই কুকুরের কামড় খাওয়া থেকে এবং তারপর তো ইঞ্জেকশন ইত্যাদি আছেই, আমি মনে মনে ভাবলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম আসে পাশে যদি কোনো লাঠিসোটা পাওয়া যায়, হঠাৎ দেখি আমার পায়ের প্রায় এক ফুট সামনে একটা সাপ হলহলিয়ে এগিয়ে আসছে। সাপ সম্পর্কে জ্ঞান আমার হেলে সাপ অব্দিই সীমিত তাই কি সাপ বুঝলাম না। তবে যখন হেলে নয়, তবে নিশ্চয় বিষাক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কুকুরটি এসে অতর্কিতে সাপটার গায়ে বসিয়ে দিল থাবা। ভয়ঙ্কর প্রাণীদের তালিকায় সাপ কুকুরের তুলনায় অনেক ওপরে, অন্তত আমার কাছে। আমি আর কিছু দ্বিতীয় কথা না ভেবে প্রায় ছুট্টে রাস্তার ওপর প্রান্তে গিয়ে টেনে হাঁটা লাগলাম। অনেকটা দূর যাওয়ার পর পিছনে ফিরে দেখলাম সাপ ও কুকুরটির তখনও যুদ্ধ চলছে। ভাবলাম সত্যি, কুকুরটা না থাকলে আজ আমি সাপটার ঘাড়ে পা দিতামই। মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। আমি ওকে কি করে মারা যায় তার ব্যবস্থা করছিলাম আর তার মনে এই ছিল। ফেরার পথে দেখলাম ওই জায়গাতেই সাপটা মরে পরে আছে, মাথাটা ক্ষতবিক্ষত। ঘরে ঢোকার সময় দেখি ওই কুকুরটা সামনের আস্তাকুর থেকে খাবার খুঁজে খাচ্ছে। মনে মনে আস্যস্ত হলাম, যাক তবে কুকুরটা সাপের কামড়ে মরেনি। মনে মনে ওকে ধন্যবাদ জানালাম। এরপর থেকে রাস্তায় বেড়োলেই কুকুরটা চোখে পড়তো। এরকম সাহায্য করা যেন কুকুরটার অভ্যেস এবং ওকে ভুল বোঝাও পথ চলতি মানুষগুলোর রোজনামচা। যেমন, রোজ রাতে দেখতাম সারা পাড়া ঘুমিয়ে পড়লে ওই কুকুরটা আমার বাড়ির সামনের বাড়িটার দালানে বসত। বাড়িটা এক বড় মাপের বুদ্ধিজীবীর বলেই আমি জানি। আমি লক্ষ্য করেছিলাম ওদের বাড়ির উচ্ছিষ্টগুলো পাশের আস্তাকুরটাতে ওরাই ফেলতো, কুকুরটার রোজকার খাবার ওখান থেকেই জুটত। সে হয়তো মনে মনে ওই বাড়ির বাসিন্দাদের অজান্তেই ওই বাড়িটাকে নিজের মালিকের বাড়ি ভেবে বসেছিল। সারারাত সে পাহারা দিত ওই বাড়ির দালানে। একবার তো ওই বাড়িতে এক চোরও ধরা পড়লো ওর চিল চিৎকারে। যদিও কুকুরটার কোনো কৃতিত্বই স্বীকার করা হয়নি, বলাই বাহুল্য।

এভাবেই কাটছিল, হঠাৎ একদিন দেখি কুকুরটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। সেই প্রাণোচ্ছল আচরণ আর নেই। পাড়ায় আর দেখাও যায়না সেরকম, শুধু খাবার সময় আসে ওই আস্তাকুরটাতে। কিছুদিন পর বুঝলাম সে অন্তঃসত্ত্বা। একদিন সকালে উঠে দেখলাম কুকুরটা চারটে ফুটফুটে সদ্যজাত ছানা নিয়ে বসে আছে ওই দালানে। চোখের সামনে রোজ দেখছিলাম একটি প্রাণচঞ্চল প্রাণীকেও মাতৃত্ব কেমন একটু একটু করে বদলে দেয়। সারাদিন সে আগলে রাখে তার শিশুগুলোকে। ছানাগুলোর মাতৃ দুগ্ধ পানের দৃশ্য দেখে আমার মন ভরে যেত। ওর নিজের যদিও খাবারের একটু টান পড়ছিল। ওই দালান বাড়ির সদস্যরা ওর প্রসবের দিনের আগে থেকেই বাড়িতে নেই। তাই উচ্ছিষ্টও নেই। সে কয়দিন আমিই খাবার দিচ্ছিলাম ওকে। যেন মনে হচ্ছিল তবে এতদিনে কিছু ঋণ শোধ করতে পারছি আমি ওর কাছে। আমি ঐ দালানে আমার একটা বাদ পরা কম্বলও বিছিয়ে দিয়ে এসেছিলাম ওদের জন্য। একদিন আমি অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি কুকুরটা আমার বাড়ির দরজার চৌকাঠে বসে ধুঁকছে। ওর পেটের কাছটায় লাল দগদগে ঘা, পুড়ে গেছে যেন কিছুতে। তা থেকে রক্তরস ঝরে চলেছে অনবরত, আর ওর চোখের কোনটা জলে ভেজা। আমাকে দেখেই সে আর্ত চিৎকার করে উঠলো, যেন অনেকক্ষণ ধরে জমে থাকা একরাশ কষ্ট বের হয়ে এলো ওর ওই আওয়াজের মধ্যে দিয়ে। আমি কিছু না ভেবে ওকে কোলে তুলে নিলাম। আমার এক সহকর্মীর ভগ্নিপতি পশুচিকিৎক এবং একটি পশুচিকিৎসালয়ের সাথে যুক্ত। তার সাহচর্যেই বাঁচিয়ে তুলি আমার কুট্টুসকে। তারপর থেকেই আমার চিরসঙ্গী ও।” ওরা দুজনে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো। কুট্টুস খাটের নিচেই বসে জিরোচ্ছিলো এতক্ষন। আমার বলা শেষ করার পর দুজনেই অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। তা দেখে কুট্টুসও বোধয় বুঝলো যে কথাটা তাকে নিয়েই হচ্ছে। ও গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। বৌদি ওর দিকে তাকিয়েই উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু কিভাবে হলো এসব? আর ওর বাচ্ছাগুলোরই বা কি হলো?” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “পাড়ার লোকজনের কাছে পরে শুনেছিলাম কয়েকদিন আগেই নাকি ওবাড়ির লোকজন ফিরেছিল। বাড়ির দালানে একটা নোংরা রাস্তার কুকুর আর ওই বাচ্চাগুলোর চিৎকার ও দুগন্ধে ওরা নাকি অত্যন্ত অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাই নাকি এই অবাঞ্ছিত অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে প্রথমে কয়েকটা ঢিল ছোড়ে ওদের দিকে। তাতে কিছুক্ষনের জন্য সরে গেলেও আবার ফিরে গেছিলো বিকেলের দিকে মা সহ শিশুগুলো। ঢিল ছোড়ায় কাজ না দেওয়ায় তাই দোতলা থেকে ওদের লক্ষ্য করে শেষমেষ এসিড ছোঁড়া হয়, যাতে ওরা পালিয়ে যায় এবং আর মনের ভুলেও যেন ফিরে না আসে। বলাই বাহুল্য ওদের পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল। ওরা আর ফেরেনি কখনো। কুট্টুস আমার কাছে আশ্রয় পেয়েছে আর বাকিরা হয়তো ঈশ্বরের কাছে।”

কথাটা শেষ করে দেখলাম বৌদির চোখে জল। কুট্টুসকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগলো সে। শিবালিকও কুট্টুসের মাথাটা একটু নেড়ে দিয়ে বললো, ”তুই ওদের কিছু বলিসনি! এগুলো তো অন্যায়, পাশবিক।” আমি বললাম, “অন্যায় আর পাশবিকতার মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য আছে রে। অন্যায় মানুষ করে, কিন্তু পাশবিকতা মানুষের কর্ম নয়। এমনকি পশুদেরও এই ধরনের মানুষরূপী পশুদের দলে ফেলা যায়না। তাই কোনো মানুষকে হয়তো এই বিষয়ে কিছু বলে অন্তত কিছুটা লজ্জা বা অনুতাপবোধের আশা করা যায়, এদের কাছে নয়। তাছাড়া আমি সামান্য একটা কেরানি, তারা বুদ্ধিজীবী। তাদের উপর কথা বলি তার আমার সাধ্যি কোথায়!” সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় ওরা বেড়িয়ে পড়লো। কুট্টুসও আমার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় জানালো। ঘরে ধোঁকার আগে রোজকার মতো একবার তাকালো সামনের বাড়ির দালানটার দিকে। ওর এই দৃষ্টি আমার চেনা। অত্যন্ত করুণ ও মাতৃস্নেহে ভরা সে দৃষ্টি। আমি ওর দুঃস্বপ্নময় স্মৃতির মাঝে দরজাটা টেনে দিলাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one + ten =