অঞ্জনা
অচেনা অথচ গুরুত্বপূর্ণ, পুরাণে রয়েছে এমন অসংখ্য নারী চরিত্র। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখা থাকছে অবেক্ষণ–এ। বড়দিন সংখ্যা থেকে শুরু হচ্ছে হনুমানের মা অঞ্জনার কাহিনী। এবারে প্রথম পর্ব, লিখছেন ময়ুমী সেনগুপ্ত।
মহাবলী হনুমানের মায়ের নাম ছিল অঞ্জনা। সেই সূত্রে হনুমান আঞ্জনেয় নামে পরিচিত। কিন্তু অঞ্জনা যে পূর্বজন্মে এক অপ্সরা ছিলেন একথা অনেকেরই অজ্ঞাত।
অঞ্জনার বানরকুলে জন্ম তাঁর দুর্ভাগ্যের কারণ। সে কথা জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে অনেক কাল আগে। এক যে ছিল অপ্সরা। নাম পুঞ্জীকস্থলা। মা-বাবা তো দূর কেউ ছিল না সেই লাবণ্যময়ী নারীর। দেবগুরু বৃহস্পতির আশ্রয়ে থাকতো সেই মেয়েটি। কঠোর অনুশাসনে বড় হয়ে উঠেছিল সে। আশ্রিতা হলেও দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে সে কন্যাসমা ব্যবহারই পেয়ে এসেছে ছোট থেকেই।
স্বর্গের যত্র তত্র অবাধে ভ্রমণ করে বেড়ায় পুঞ্জীকস্থলা। দেবগুরু বৃহস্পতির পালিতা কন্যাকে সকলেই সম্মান করে ,বিশেষ স্নেহ করেন। নিজের অজান্তেই মেয়েটি হয়ে উঠলো একটু দাম্ভিক। দেবগুরু কিন্তু অত শত খেয়াল করলেন না। তিনি তখন পুঞ্জীকস্থলাকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী করে তুলতে ব্যস্ত।
এদিকে একদিন পবনদেবের সঙ্গে দেখা হয় পুঞ্জীকস্থলার। অপ্সরার অনুপম সৌন্দর্য মুগ্ধ করে বায়ুদেবকে। পবনদেবের আন্তরিকতায় পুঞ্জীকস্থলাও আকৃষ্ট হয় তাঁর প্রতি। ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব ক্রমে প্রেমে পরিণত হয়।
চিরকাল প্রবল অনুশাসনের মধ্যে লালিত পালিত পুঞ্জীকস্থলা প্রেমের পরশে যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। ভালো লাগে না আর এই কড়াকড়ি , এতো নিয়মের বেড়াজাল। মনে হয় এক ছুটে চলে যাই সেই দেবতার কাছে , যাঁর কাছে কোনো নিয়মের শিকল নেই, আছে শুধু প্রেমসাগরে অবগাহনের আনন্দ। তাই তো আর মন টেকে না দেবগুরু বৃহস্পতির গৃহে। ভুল হয়ে যায় নিত্যকর্মে। ভুল হয়ে যায় পিতার পূজার পুষ্পচয়নে। বৃহস্পতি অবাক হয়ে কন্যার ভাবান্তর দেখেন। পত্নী তারা বোঝান এ বয়সন্ধিকালে মেয়ে কেন ছেলে থাকলে তার আচরণেও বিস্তর পরিবর্তন চোখে পড়তো।
কেন জানি না বৃহস্পতি ঠিক মানতে পারলেন না তারার কথা। মেয়েটা দিন দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই মন নেই দেহটাই একমাত্র বাড়িতে থাকে। মন যেন পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও। মেয়েটার আচার আচরণে যেন চাপা উগ্রতা। এদিকে কানে আসে পবনদেবের সঙ্গে মেয়ের অভিসারের কথা। বিশ্বাস করতে পারেন না নিজের কানকে দেবগুরু। আবার লোকের মুখের কথাকে উড়িয়েও দিতে পারেন না। এদিকে সংকোচবশতঃ মেয়েকেও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেন না।
স্বামীকে আনমনা দেখে তারা বোঝেন কিছু একটা হয়েছে। বহু চেষ্টায় অবশেষে স্বামী মুখ খোলেন। তারা সব শুনে স্বামীকে বোঝান , দেখো মেয়ে তো অন্যায় কিছু করেনি। আর এ তো যুগ যুগ ধরে হয়ে এসেছে। দেবতাদের সঙ্গে অপ্সরাদের প্রেম তো নতুন কিছু নয়। আর এতে অন্যায়ের কিছুই নেই।
মা-বাবারই তো উচিত কন্যা উপযুক্ত বয়োপ্রাপ্তি হলে তাঁর জন্য যোগ্য বরের সন্ধান করা। তা মেয়ে নিজেই তার স্বামী খুঁজে নিয়েছে। এতে তো তাঁদের খুশি হওয়ার কথা। মা-বা হিসেবে এ কাজ তো তাঁদেরই করবার কথা ছিল। এদিকে কন্যা নিজেই সেই কাজ করে নিলো। এতে তো তাঁদের দায়িত্ব অর্ধেক কমে গেলো।
আর তাছাড়া পবনদেবকে জামাতা হিসেবে পেলে তারা যে পরম আনন্দিত হবেন , সে কথাও স্বামীকে জানাতে ভুললেন না।
এদিকে দেবগুরুর মন কিছুতেই মানে না। খালি মন যেন বলে ওঠে বার বার, এ তোমার শিক্ষার অপমান। আর কি কটা দিন অপেক্ষা করতে মেয়েটা পারতো না ! পিতাই না হয় তাঁর জন্য যোগ্য পাত্র সন্ধান করে আনতেন। আর কয়েকটা দিন তোর তর সইলো না মেয়ে।
কত স্বপ্ন ছিল দেবগুরুর দুই চোখে। নিজের হাতে মেয়েকে তুলে দেবেন স্বীয় নির্বাচিত জীবনসঙ্গীর হাতে। সব কিছু কেমন গন্ডগোল করে দিলো আদরের মেয়েটাই। লোকে ঠিকই বলে এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না। তাই তো মেয়ের কথা তাঁকে তারার থেকে শুনতে হলো। কেন একবারও বাবার কাছে এসে মেয়ে নিজের মনের কথা জানাতে পারলো না। ছেলেবেলা থেকে তো তার সব আবদার বাবাই মিটিয়েছেন , মা নয়। বৃহস্পতির যেন কোথায় নিজেকে পরাজিত বলে মনে হচ্ছিলো।
এখানেই বৃহস্পতির খুব বড় একটা ভুল হয়েছিল। মেয়েরা যতই বাবাকে গুরুত্ব দিক না কেন , জীবনের কিছু কিছু পরিস্থিতিতে তারা কিন্তু জননীকেই খোঁজে , পিতাকে নয়। তখন কোথাও যেন একটা লজ্জা এসে ভর করে তাদের দেহমনে। তারা তখন সেই অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে মায়ের স্নেহময়ী আশ্রয় পেতে চায়। আর তাছাড়া তারাকে কিন্তু তাঁদের পালিত কন্যা কোনো কথাই বলেনি।
একদিন নিজের চোখে তারা দেখেছিলেন পবনদেবের সঙ্গে কন্যাকে। মায়ের চোখ ভুল করেনি মেয়ের মনের গতি প্রকৃতি বুঝতে। সেদিন কিছু না বললেও এর আগে মেয়েকে নিয়ে বলা লোকের কিছু কথা তারার কানেও এসেছে। এবার বুঝলেন তাঁরা অসত্য বলেনি। মেয়ের হাসি , তার চোখ বলে দিচ্ছে পবনদেবের প্রতি তার অনুরাগের কথা।
মেয়ের কথায় ব্যথা পেলেও তারা নীরব থাকেন। মনের দুঃখ মনেই চেপে রাখেন মা। আর এদিকে পুঞ্জীকস্থলা ভাবেন , মা নিজেই অপরাধের ভারে জর্জরিত। তিনি আর আমাকে কি শাসন করবেন ! সেদিনের পর থেকে তারা সবই লক্ষ্য করেন। কিন্তু এ নিয়ে মেয়েকে একটি কথাও বলেন না। আসলে তারার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে মেয়ে হয়তো মায়ের নীরব অভিমান বুঝবে। নিজের লালন পালনের উপর এটুকু ভরসা ছিল সেই মায়ের।
কিন্তু এর ফল হলো বিপরীত। মায়ের নীরবতায় প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়ে পুঞ্জীকস্থলা আরো উদ্ধত হয়ে উঠলো। যেটুকু পর্দা ছিল তার আচার আচরণে , সেটুকুও খসে গেলো। মায়ের সামনেই সে নির্বিকার ভাবে পবনদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চলে যায়। সব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া তারার আর কোনো উপায় নেই। তিনি শুধু শংকিত হন সেদিনের কথা ভেবে , যেদিন বৃহস্পতির চোখে পুঞ্জীকস্থলার এই আচরণ ধরা পড়বে , সেদিন এই মেয়ের পরিণতি কি হবে ! আর সেদিনের ঘটনার পর পুঞ্জীকস্থলা মায়ের সঙ্গে দরকার ছাড়া বড় একটা বাক্যালাপও করে না।
এদিকে যে কথা এতদিন কানা ঘুষোয় যে কথা দেবগুরুর কানে আসছিলো , তা একদিন স্বয়ং প্রত্যক্ষ করলেন বৃহস্পতি। দূর থেকে দেখেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। এ কি তাঁর মেয়ে ! যাকে একটু একটু করে সেই কোন ছোট থেকে এতো বড়ো করে তুলেছেন। লোকের কথা তা হলে মিথ্যা নয়। না , আজ বাড়ি ফিরে এর কৈফিয়ত দিতেই হবে পুঞ্জীকস্থলাকে।
প্রণয়ের সম্পর্ক থাকতেই পারে , তা বলে প্রকাশ্য দিবালোকে এমন আচরণ ! লাস্যে যৌবনের অহংকারে শালীনতার সীমাকে কি ভাবে অতিক্রম করে চলেছে পুঞ্জীকস্থলা। অল্প বয়সে আবেগ থাকা স্বাভাবিক , কিন্তু এমনধারা আচরণ ! এ যে মেনে নেয়া যায় না।
তাই তো আজ সকলের মুখে মুখে ফিরছে তাঁর কন্যার কথা। ইদানিং তিনি লক্ষ্য করেছেন তাঁকে দেখলেই সকলের গুঞ্জন। যদিও দেবগুরুর সামনে সকলেই বিনীত। কিন্তু এ ভাবে আর কতদিন সত্যকে চাপা দেয়া যাবে ? তা তো একদিন না একদিন চাই চাপা আগুনের মতো আত্মপ্রকাশ করবেই। তখন এক মুহূর্তে বৃহস্পতির এতদিনের মর্যাদার , আভিজাত্যের অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। একবার তারার কারণে তাঁকে অনেক বিব্রত হতে হয়েছে। কিন্তু এবারে আর নয়। পুঞ্জীকস্থলার কারণে কোনো ভাবেই নিজের সম্মানের আসনে অমর্যাদার ধূলি নিক্ষেপিত হতে দেবেন না তিনি।
কি ভেবেছে পুঞ্জীকস্থলা? এতে যে তাঁর পিতার মর্যাদার হানি ঘটছে , সেই বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছে সে। সেরকম হলে না হয় মায়ের কাছেই সে নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারতো। আর তারাই বা কি। মেয়ের উশৃঙ্খলতা যে এতো চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে , সে কথা তাঁকে জানানোর প্রয়োজনটুকুও মনে করেনি সে।
নিজেকে অপরিসীম মনোবলে সংযত করলেন বৃহস্পতি। এ বৃহস্পতি আর আগের বৃহস্পতি নন। স্ত্রী তারার পরপুরুষে অনুরক্তি তাঁকে অনেক পরিবর্তিত করেছে। গৃহত্যাগিনী স্ত্রীকে পুনরায় গৃহে স্থান দিতে গিয়ে অনেক নীতিবোধের বিসর্জন দিতে হয়েছে আপন স্বার্থেই।
দ্রুত গৃহে ফিরলেন ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি। এসেই তারার ডাক পড়লো শয়নকক্ষে। বহু বছরের মধ্যে স্বামীর এরকম গম্ভীর কণ্ঠস্বর তারা শোনেননি। প্রমাদ গুণলেন তারা মনে মনে। তবে যে ভয় পাচ্ছিলাম মনে মনে তাই সত্য হলো। নিশ্চয় স্বামী মেয়েকে পবনদেবের সঙ্গে দেখেছেন। তাই এতো তড়িঘড়ি তলব তারাকে তাও আবার শয়নকক্ষে। মেয়ের আচরণের কৈফিয়ত মাকে তো দিতে হবেই।
কোনো ভূমিকা না করেই স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন দেবগুরু , মেয়ের আচরণ যে শালীনতার সীমা ছাড়িয়েছে সে খবর রাখবার সময় রয়েছে তোমার ? তারা একবার বলতে চেষ্টা করলেন , মেয়েকে একদিন তিনি নিজের কাছে ডেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আখেরে কোনো লাভ হয়নি।
কর্ণপাত করলেন না বৃহস্পতি। মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম অনেক ভরসা করে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের মূল্য যে এরকম ভাবে চোকাতে হবে , তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
স্ত্রীর কাতর দৃষ্টির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বলে চললেন দেবগুরু , আসলে এরকমটাই তো হওয়ার কথা ছিল। যে রমণী নিজেই গৃহজীবনের মর্যাদা দিতে শেখেনি , সে আর সন্তানকে কি করে সঠিক অনুশাসন প্রদান করবে ! আসলে নির্বুদ্ধিতা আমারি। ভেবেছিলাম নিজে জীবনে একবার ভুল করেছো। আর কোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তোমার দ্বারা। কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষে তুমি আসলে পুঞ্জীকস্থলাকে বিপথে চালিত করেছো। তাই সে আজ আমার দেয়া যাবতীয় শিক্ষার অমর্যাদা করছে। কিন্তু আমি এই অন্যায় কোনো ভাবেই মেনে নেবো না। যুগ যুগান্তর ধরে যে সম্মানের অট্টালিকা একটু একটু করে আমি গড়ে তুলেছি , তা আমার নির্বোধ কন্যার জন্য এক লহমায় ধূলিসাৎ হতে আমি দেব না।
আর আমি খুব ভালো করে জানি এ তোমার ষড়যন্ত্র। সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে তুমি আমার আদরের মেয়েকে আমার বিরুদ্ধাচরণ করিয়েছো আমাকে সকলের সামনে হেয় করবার জন্য। আমাকে অপমান করে তোমার আসল উদ্যেশ্য , সে কি আমি বুঝি না ভেবেছো। আজও বিবাহের এতো বছর পরেও , তোমার মনে সেই চন্দ্রের একচ্ছত্র আধিপত্য , সে কি আমি বুঝি না ভেবেছো। তোমার সঙ্গে বিবাহ আমার জীবনের চরমতম ভুল। আর সেই ভুলের মাশুল দিয়ে চলেছি আমি ক্রমাগত।
স্ত্রীর করুণ মুখ দেখেও থামলেন না বৃহস্পতি। উগরে চললেন একের পর এক জ্বালাময়ী বাক্যের তীর। আসলে জানো তো তারা , তুমি কোনোদিন আমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারো নি। বাধ্য হয়ে তোমায় চলে আসতে হয়েছিল চন্দ্রকে ছেড়ে।আমার জনপ্রিয়তা তোমার চক্ষুশূল। তাছাড়া আমার জন্যই তো তোমার আর চন্দ্রের সন্তান বুধ তোমার কাছে নেই। চন্দ্রের শেষ চিহ্নকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলে তুমি। তারই প্রতিশোধ নিলে তুমি আমার মেয়েকে আমার বিরুদ্ধে করে দিয়ে। আমাকে দুঃখ দিয়ে চিরকাল তুমি এক অদ্ভুত তৃপ্তি পাও।
এবার আর চুপ করে রইলেন না তারা। বললেন শুনুন বৃহস্পতি। অনেক অভিযোগ করলেন আপনি আমার বিরুদ্ধে। যদিও তার সব কটি ভিত্তিহীন। আজ বুধকে কাছে পাই নি বলেই এই মেয়েকে আমি প্রাণের সুধা দিয়ে গড়ে তুলেছিলাম একটু একটু করে। গর্ভে তাকে আমি ধারণ করি নি। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন , সে আমার কাছে বুধের চেয়ে কোনো অংশে কম প্রিয় নয়। আর আজ তার এই অধঃপতন দেখে আপনার মতো আমিও অন্তরে দারুণ মর্মাহত। আর আপনার প্রতি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি আমাদের সন্তানকে বিপথে পরিচালিত করবো , এমনতরো হীন ধারণা আপনার হলো কি করে ? হ্যাঁ , এই মেয়েকে আমি আপনার ও আমার সন্তান বলেই মনে করি।
একটু থমকালেন বৃহস্পতি। তার হিসেবের সঙ্গে তো মিলছে না তারার মুখভঙ্গি , আচার আচরণ। মাতৃসুলভ দুঃখের গভীর চাপ তাঁর মুখে পরিস্ফুট। নিজের অগোচরেই বলে ফেললেন বৃহস্পতি , সব কিছু জেনেও তুমি আমাকে কেন বল নি?
এ প্রশ্নের জন্যই তৈরী ছিলেন যেন তারা। বলে উঠলেন , তার মূলেও রয়েছে এক অসহায় জননীর স্নেহ। কারণ আপনার ভয়ঙ্কর ক্রোধের আগুন থেকে আমি আমাদের সন্তানকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। মেয়ের প্রতি আমার স্নেহই আমার কণ্ঠ রোধ করেছিল। তাছাড়া আমি পূর্বেই আপনাকে বলেছিলাম , যে পুঞ্জীকস্থলা দুর্বার হওয়ার আগেই ওর গতি রোধ করুন , ওকে বেঁধে দিন ওর প্রিয়তমের সঙ্গে। সেদিন হয়তো তারার সেই সাবধানবাণী আপনার কাছে প্রলাপ বলে মনে হয়েছিল। আজ দেখছেন তো এর কি পরিণাম। ভুলে গেলে চলবে কেন আমাদের মেয়ের লালন পালন আমরা দুজনে করলেও , আদতে তাঁর ধমনীতে বইছে অপ্সরার রক্ত। আর রক্ত একদিন স্বধর্ম প্রদর্শন করবেই।
আরো বলে চললেন তারা। যে আর কেউ না জানুক , আমি-আপনি অন্তত জানি যে , আমাকে আপনি ফিরিয়ে এনেছিলেন নিজের পৌরুষ্যত্বের পরাজয় রোধ করবার জন্য। সেখানে আমার প্রতি কতটা ভালোবাসা ছিল , তা আমার জানা নেই , তবে চন্দ্রের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতায় নামবার জন্য আপনি যে বদ্ধপরিকর ছিলেন , তা বুঝতে তারার বাকি নেই। নচেৎ এক গৃহত্যাগিনীকে ফিরিয়ে আনবার জন্য আপনি এতো কেন উদগ্রীব ছিলেন বলুন তো দেবগুরু ! আমি তো আপনার কাছে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা একটা সুসজ্জিত আসবাব ভিন্ন অন্য কিছুই নই।
যাক আমাদের দুজনের কথা থাকে। পুঞ্জীকস্থলার কথায় আসি। আমি জানি সে অন্যায় করেছে। আর আমি তাকে শাসনের চেষ্টাও করেছিলাম। যদিও তাতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। তবুও দেবগুরু আপনাকে এই মা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে , যে সে আবার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে নিজের সন্তানকে সংযত করবার। সাফল্য মিলবে কিনা জানা নেই। তবে যদি তাকে একবার ফেরাতে পারি , তাহলে কিন্তু আর দেরি করা চলবে না। আপনাকে সোজা যেতে হবে পবনদেবের কাছে পুঞ্জীকস্থলার সঙ্গে তাঁর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে। দাম্পত্যের নিবিড় বন্ধনে বেঁধে দিতে হবে আমাদের মেয়েকে।
তারার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো জলে ভিজে গেলো দেবগুরুর। মনে মনে বললেন , মার্জনা কোরো তারা , তোমার স্বামীকে নয় , তোমার সন্তানের পিতাকে।
এরপর এলো সেই ভয়ঙ্কর দিন। কোনো এক বিশেষ কাজ সেরে ফিরছিলেন বৃহস্পতি। তারার কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছিলেন। এই কদিন একটি কথাও বলেননি মেয়েকে। শুধু গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন , বড় হয়েছো। আর কদিন পর পরের ঘরে পাঠাতে হবে। মায়ের কাছে একটু একটু করে ঘরকন্নার পাঠ নাও। জননীকে দেখেও তো কিছু শিখতে পারো। পিতার এহেন আদেশে একটু বিস্মিতই হয়েছিল পুঞ্জীকস্থলা। কারণ জ্ঞান বয়স থেকে সে পিতাকে অন্তত জননীর হয়ে বিশেষ কথা বলতে দেখেনি। তখনকার মতো মাথা নেড়ে পিতার কথায় সম্মতি জানিয়েছিল।
বৃহস্পতি সেদিন একাকী ছিলেন। সেদিন তারার-ও তাঁর সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুঞ্জীকস্থলার দুর্ভাগ্যের জন্যই হয়তো তারা সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন। নিজের মনে পথ চলছিলেন বৃহস্পতি। চারিদিকে সবুজের সমারোহ , শান্তশ্রী মুগ্দ্ধ করেছিল তাঁকে। হঠাৎ চোখে পড়লো কয়েক জন যুবক। অক্লেশে অশালীন শব্দ প্রয়োগ করে চলেছে। তাঁদের দৃষ্টি অনুসরণ করে যা দেখলেন তাতে দেবগুরুর চক্ষু স্থির হয়ে গেলো। অদূরেই এক পদ্মসরোবর। সেখানে মনের সুখে জলকেলী করে চলেছেন বায়ুদেব আর তাঁর পালিত কন্যা পুঞ্জীকস্থলা। সিক্ত বসনে পুঞ্জীকস্থলার সৌন্দর্য বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তার সেই দৈহিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় রত সেই যুবকগণ।
পুঞ্জীকস্থলার অবশ্য এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং সে ওই যুবকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেই আরো বেশি উদ্দাম হয়ে উঠছে। আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করে স্তম্ভিত হলেন বৃহস্পতি , তা হলো এ বিষয়ে পবনদেব সম্পূর্ণ উদাসীন। তাঁর দুচোখে শুধুই মুগ্ধতা। সেখানে কাম ভাবের এতটুকুও অস্তিত্ব নেই। ( চলবে…)