আরণ্যকে দ্বিপ্রহর
অনুপ কুমার সরকার ##
বিড়বিড় করে বয়ে চলা পশ্চিমা বাতাসে দাপটে জানালার পাল্লা খুলে গেল। তখন অতীন্দ্রের ঘরের টেবিলে রাখা কিছু বইয়ের পাতা আপনা আপনি উল্টে যাচ্ছে।
“আবার রৌদ্রদগ্ধ নিষ্পত্র গুল্মরাজি, আবার বন কুসুমের মৃদু মধুর গন্ধ, আবার রক্তপলাশের শোভা।” বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের এই লাইন পড়তে পড়তে মনোযোগ ঘুরিয়া গেল বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টানো শব্দে। বাইরে চোখ মেলতেই অতীন্দ্র দেখল বিড়বিড় করে বয়ে চলা বাতাসের গতিবেগ খানিকটা বেড়ে গেল। নরম সবুজ ধান গাছগুলোর মাথা নাড়াচাড়া করছে ঠিকই তবে যেখান দিয়ে বা যে পথ দিয়ে বাতাস বয়ে চলেছে সেই পথেই একটা হালকা রূপরেখা তৈরি হয়ে যাচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন ভরা যৌবনে নদীর বুক দিয়ে স্টিমার চলে গেলে যেরকম তৈরি হয়। অতীন্দ্রের ঘরের জানলা থেকে সবুজ ধানের ক্ষেত সম্পূর্ণই নাগালের মধ্যে। খুব বেশি হলে আধশো মিটার এর বেশি নয়, কমই বৈকি। জানালা খুললেই যাদের সাথে দেখা হয়, আম, জাম, নারকেল, কদম তো আছেই সাথে সজিনা পাতার নড়াচড়া সবসময়ই চোখে পড়ার মতো। বেলা গড়ার সময় নারকেল পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে খোলা জানালার ভিতর দিয়ে যেন শেষ বিকেলে যাওয়ার আগে রবিরশ্মি স্নান করিয়া দিয়ে যায়। অন্যদিকে কাঁঠাল গাছকে দেখে অতীন্দ্র যা ছবি আঁকল মনের অন্তরালে তা হল-
হায় ছায়াবৃতা
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরুপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আফ্রিকা কবিতার এই বিখ্যাত লাইনে মনের চিলেকোঠায় দোলা দিয়ে যায়। প্রখর গ্রীষ্মের দাবানলেও আফ্রিকার জঙ্গলের মতো অতীন্দ্রের জানালার পাশে কাঠাল তলাকে মনে হয় যেন কালো ঘোমটার তলদেশ। অন্যদিকে একজোড়া লম্বা কদম গাছ যেন আকাশ ভেদিয়া উপরে উঠে যাবার উপক্রম।
গতরাতে বৃষ্টির জন্য পরিবেশটা বেশ নরম মনে হচ্ছিল। অতীন্দ্র সকাল থেকেই একমনে নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছে ‘আরণ্যক’ নিয়ে। আরন্যকেই ডুবে যাচ্ছে বারেবারে, নেশায় যেন ঘুমন্ত হয়ে উঠছে অতীন্দ্র। টিনের চালে একজোড়া শালিক আর আম্রপালি গাছের ডালে ডালে প্রায় পাঁচ সাতটা সাতভায়রার ঝগড়াতে আবারও মনোযোগ সরিয়া গেল। “নিস্তব্ধ দুপুরে দূরে মহালিখারূপের পাহাড় ও জঙ্গল অপূর্ব রহস্যময় দেখাইতো।” এই লাইনে এসে থেমে গিয়ে আরণ্যককে কিছু সময়ের জন্য বিরতি দিল অতীন্দ্র। সবুজ নরম ধানক্ষেতে যেহেতু কোনোরকম আইল চোখে পরছে না মনে হচ্ছে সবুজ চাদর মেলে দেওয়া হয়েছে। অতীন্দ্রের ঘরে থেকে বাঁশ বাগানটা দেখা যায় না ঠিকই কিন্তু বেলা শেষে আশেপাশের বিভিন্ন গাছ থেকেই কোকিলের কুহু কুহু শব্দ কানে এসে পৌঁছায়। বহু বছর পরে হঠাৎ অতীন্দের চোখে পড়লো গতরাতে নীড় ভাঙা টুনটুনি খুঁজে বেড়াচ্ছে কোথায় বাসা বাঁধা যায়। রবির আলোর উজ্জ্বলতা কখন ম্লান হয়ে গেছে মনেই নাই। সারাদিন আলোকিত সূর্যের তেজস্বী রবিরশ্মি বেলা গড়ার সাথে সাথে একটা লাল বৃত্তের ন্যায় হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কিছু সময়ের মধ্যে ওই পশ্চিম পাড়ার তাল সারির মাথায় ডুবিয়া গেল। জানালার পাল্লা ভেদিয়া আর দরজার কপাট খুলিয়া ফাঁকা মাঠে এসে একা একাই পশ্চিম আকাশে জ্বলজ্বলে শুকতারাকে দেখে নিজের একাকিত্বের স্বাদ নিতে থাকল।