ইছামতী পাড়ের রোজনামচা
সুমেধা চট্টোপাধ্যায়
‘ইছামতী’। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত এক অরূপরতন। ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ে ছোটবেলায় যেমন আফ্রিকা যেতে ইচ্ছা করত সব সময়ে, এই উপন্যাসটি পড়ে খুব মনে হত ছুট্টে চলে যাই ‘সেই নদীতীরে’।
এরকমই এক সুযোগ এল এবছর ২৬শে জানুয়ারী। ইছামতীর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের পরম ভালবাসার বাহনটিতে উঠে পড়লাম। সেই চকিত ভ্রমণের রোজনামচা আজ।
২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৮
এক চালক(আমার স্বামী সৌমিত্র) ও তিন আরোহী (আমি, টিনটিন ও আমার বোন তুলি)কে নিয়ে আমাদের অল্টো বাসন্তী হাইওয়ে ধরল সকাল তখন প্রায় আটটা। খুবই ভাল রাস্তা। আমি শুধু দূরের ক্ষেতগুলোতে সর্ষের আগুন দেখতে লাগলাম। পথে এক জায়গায় কিছু খাওয়া হল। টাকি যখন ঢুকলাম তখন বেলা সাড়ে দশটা। আমাদের বুকিং ছিল নৃপেন্দ্র অতিথিশালায়। এটি আদতে মিউনিসিপ্যালিটি গেস্ট হাউস। ম্যানেজার প্রসেঞ্জিৎ বাবু অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। অল্প পেটপুজো করে, দুপুরের খাবার বলে আমরা একটি টোটোতে করে বেরিয়ে পড়লাম। সারথির নাম স্থানীয় মিজানুর। আমার ভাবগতিক দেখে তার বিনম্র অনুরোধ “দিদি, আপনি জায়গার লিস্টটা সাথে নিয়েই চলুন, দেখতে দেখতে টিক মেরে নেবেন। তবে নিশ্চিন্ত থাকুন কিছু অতিরিক্ত স্পটও দেখাবো।” আমি বেশ অবাক হলাম। এতো দ্রুত আমার মনের কথা পড়ে ফেললো আদ্যন্ত গ্রাম্য এই সিদেসাধা মানুষটা! বিস্মিত।
ইছামতীকে সাথে রেখেই বেশ উঁচু নীচু পথ ধরে, সে নিয়ে এসে নামাল একটি ছোট একচালার বাড়ির সামনে। চকিতে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মস্তিষ্কের অন্তরমহলে। “বিসর্জনের” বাড়িটা না! মিজানুরের মুখে জয়ের হাসি। “দেখুন তো দিদি, বাড়িটি চিনতে পারেন কিনা? এটা কিন্তু আপনার লিস্টে নেই”। তার কথায় ঘোর কাটল। তার আগে কয়েক সেকেন্ড মোহাবিষ্ট ছিলাম। মিজানুর বলার আগেই আমি যেন নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছিলাম পদ্মা (জয়া এহসান)ও নাসিরকে(আবীর চ্যাটার্জী), ঐ বাড়িতে।
পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলির জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র “বিসর্জনের” সিংহভাগের চিত্রায়ন হয় এই বাড়িটিতে। আমার অন্যতম পছন্দের সিনেমা। তাই বেশ কিছুকাল লাগলো ঘোর কাটতে। ভাললাগাটা বেশ চারিয়ে যাচ্ছিল মনে। যেখান দিয়ে কৌশিক গাঙ্গুলি (সিনেমায় “গনেশ মণ্ডল”)। আসতেন পদ্মার সাথে দেখা করতে সেই মেঠো পথ, যে ঘর গুলিতে পদ্মার শ্বশুরমশাই থাকতেন বা যে বারান্দায় নাসিরকে প্রাথমিক আশ্রয় দেন পদ্মা….সবই মিজানুর দেখালো নিষ্ঠাভরে। বাড়িটি প্রায় পরিত্যক্ত। মালিকানা সম্পর্কে বিশেষ আলোকপাত আমাদের চালক করতে পারল না। তবে কৃত্রিম সেট যে এটি নয়, তা নাবালকও বুঝতে পারবে। এখানে বিসর্জনের শুটিং হয় প্রায় দুমাসের কাছে। মিজানুর ই জানাল যে এখানকারই নদীর ধারের পাঁকে প্রথম দৃশ্য তোলা হয়। অনেক গাছ আশেপাশে, তাদের ফাঁক দিয়েই রোদের ইতিউতি। সামনে তুলসী মঞ্চ যেখানে পদ্মা রোজ সন্ধ্যে দিত। ছবি তোলা হল। ফিরে এলাম বাহনে। প্রথম ‘স্পট’ দেখিয়েই ‘বিজয়ী’ চালক টোটো ছোটাল পরের গন্তব্যে। আমি তখন ভাবছি “আমার বাংলার” অলি- গলিতে কতই না বিস্ময় এরকম ছড়িয়ে আছে….মায়াচ্ছন্ন মন পরের গন্তব্যের অপেক্ষায়।
এরপর গাড়ি এসে থামল যেখানে সামনেই একটি লেখা চোখে পড়ল।”তিষ্ঠ ক্ষণ কাল”। মনে পড়ল নেট এ দেখেছিলাম এটি একটি গেস্ট হাউস। খুবই সুন্দর অবস্থান…. সামনেই একটি “কাজলনয়না” দীঘি। এই দীঘিটির কিনারে চোখ সবে পড়েছে…. আমাদের টোটোচালক মিজানুর বললো..” বাঁদিকে দেখুন, আমাদের প্রায় দুইশত বছরের পুরোনো জোড়াশিবমন্দির”। অত্যন্ত মনোরম এবং শান্ত পরিবেশে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ঐ মন্দির দুজনের দিকে। ঠিক যেন কোন প্রাচীন সম্পদের প্রহরায় দুই রক্ষী দণ্ডায়মান। ইতিহাসটি জানলাম কিছুটা মিজানুরের মুখ থেকে আর কিছুটা সামনের বাঁধানো ফলক থেকে।
টাকি জমিদার পরিবারের ১৯তম বংশধর রামকান্তের পুত্র ও কালীনাথ মুন্সীর পিতা শ্রী গোপীনাথ রায়চৌধুরী টাকি জোড়ামন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। ১২০৮ সালের(আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে)আশ্বিন মাসে গোপীনাথ তার গুরুদেব হরিরাম বিদ্যাবাগীশ কে বাজিতপুর(অধুনা ঢাকা, বাংলাদেশ এর অন্তর্ভূক্ত) থেকে টাকিতে এনে বসবাসের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেন এবং গৃহের সামনে দুটি শিবলিঙ্গ ও পুষ্করিণী খনন করেন(সম্ভবত গুরুদক্ষিণা রূপে)।এই পুষ্করিণী ও শিবলিঙ্গ দুটিকে কেন্দ্র করে জোড়ামন্দির গড়ে ওঠে। বর্তমানে টাকি পৌরসভা এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রাপ্ত।
মন্দির দুটিতো সুন্দর বটেই, দীঘি তথা পুষ্করিণীটিও অত্যন্ত মনোরম। প্রায় মাঝদুপুরের কড়া রোদেও এখানে কিন্তু বেশ মৃদুমন্দ আভাস দিচ্ছে বাতাস। জলটি এতটাই স্বচ্ছ যে অ্যান্ডারসন ক্লাব ও লেকটাউন সুইমিংপুলে এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই সাঁতারুর (যথাক্রমে আমার বোন – তুলি ও আমি) তো এই নামে কি সেই নামে অবস্থা….কিন্তু আরো কিছু জায়গা ঘুরে আবার মধ্যাহ্ন ভোজে ফিরতে হবে। অতএব, দুই মহিলাই আত্মসংযম করলেন। পুষ্করিণীতে দুটি শিবমন্দির এর প্রতিফলন যেকোন প্রকৃতি অপ্রেমীকেও এখান দিয়ে যাওয়ার সময়ে কান- ফিসফিস করবে ” তিষ্ঠ ক্ষণ কাল”। সামনের গেস্ট হাউসটির নামের মাহাত্ম্য বুঝতে অসুবিধা হল না। আমাদের “ক্ষণকাল” অতিক্রান্ত। মিজানুরের রথ চলল পরের গন্তব্যে।
এলাম এবার জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি ও সংলগ্ন ঠাকুরদালানে। এটি টাকির একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। স্থানীয় লোকেরা খুব গর্বের সঙ্গে এটি দেখায়। জোড়াশিবমন্দিরের পর পথ চলতে চলতে এক ছায়াঘেরা অট্টালিকার সামনে এসে মিজানুর বেশ দৃপ্ত ও গর্বিত কণ্ঠে বললো যে এটি একজন প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষর পৈতৃক বাড়ি। প্রশস্ত ও বেশ বড় ঠাকুরদালান। আর বসতবাড়িটি বেশ সুন্দর এবং বড় বড় সুউচ্চ বৃক্ষাদি তার পাহারায়। চারিদিক সবুজে ভরা, চোখের আরাম নিশ্চিতভাবে।
আমার পড়াশুনো অনুসারে, শঙ্কর রায়চৌধুরী ইন্ডিয়ান আর্মির একজন প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ। জন্ম এবং পড়াশুনো সূত্রে কলকাতা ও মুসৌরিতে জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলেও, তিনি আদতে টাকির এক জমিদার পরিবারের সন্তান।বহু মেডেল এবং সম্মান কর্মজীবনে পেয়েছেন। তাই পরিবারের তথা ঘরের এই কৃতি সন্তানের পৈতৃক বাড়িটি আজ টাকির অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান।
এবার আজকের দিনের শেষ গন্তব্য গোলপাতার জঙ্গল।
মিজানুরের রথ যেখানে থামল, সেখানে একটি BSF Checkpost। এখানে প্রতিটি ভ্রমণ দলের যে কোন একজনের সচিত্র পরিচয়পত্র (preferably Voter ID Card) জমা রেখে গোলপাতার জঙ্গলে প্রবেশানুমতি নিতে হয়। এর মূল কারণ, ওপারে যেন অহেতুক, অনধিকার অনুপ্রবেশ না ঘটে। এই পরিচয়পত্র সাথের টোটো চালকেরও হতে পারে। আমাদের ক্ষেত্রে সৌমিত্রর voter ID জমা দেওয়া হল। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে এখানে। কিন্তু সমস্ত গাড়িচালককেই দেখছিলাম অসীম নৈপুণ্যে ধীরে ধীরে ঠিক লম্বা লাইনের সামনে চলে আসছেন, যাতে তাদের দলের যে ব্যাক্তি পরিচয় পত্র জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছেন তিনি কোন কাল বিলম্ব না করে সহজেই তার গাড়িকে খুঁজে পেতে পারেন। মিজানুরও তার ব্যতিক্রম হল না। এই জায়গা থেকে আরো কিছুদুর সে নিয়ে গেল আমাদের। তারপর আমরা নেমে পদব্রজে এসে উঠলাম একটি বাঁধানো ছোট সাঁকোর উপর। আশেপাশে যতদূর চোখ যায়, গোলপাতা, সুন্দরী ও হোগলার জংগল। আমার মত যারা আগে সুন্দরবন ঘুরে এসেছেন, তারা এই ক্ষণিক যাত্রার সাথে সজনেখালির “Canopy Walk” এর সাদৃশ্য পাবেন। নীচের কাদামাটি দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না, নদীতে জল বাড়লে বিশেষ করে বর্ষাকালে শক্ত-পোক্ত “Canopy” র নীচ পর্যন্তই জল চলে আসে। এই সাঁকোটি শেষ হল একদম ইছামতীকে ছুঁয়ে। আগেই বলেছি ইছামতী এখানে তার ব্যাপ্তি হারিয়ে সামান্য জৌলুসহীন। ছাত্রজীবনের জীবনবিজ্ঞান বইতে পড়া সেই শ্বাসমূলের পাড়া পার হয়ে যেন এক উদাসীন নদীর কিনারে এলাম। জংগল এর মধ্যে একটু ইতিউতি হাঁটলাম।
এই “মিনি সুন্দরবনের” সুবিধা একটাই এখানে দক্ষিণরায়ের দেখা পাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। তাই আপনি যত ইচ্ছা “সুন্দরী” দের সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন। তবে স্থানীয় লোকমুখে শুনলাম ভবিষ্যৎকাল এ বাঁধানো সাঁকোকে জালে মুড়ে নীচে কিছু প্রাণীদের ছাড়ার পরিকল্পনা টাকি পৌরসভার আছে। পূর্ণ মধ্যাহ্ন হলেও নদীর হাওয়া এবং গোলপাতার বিন্যস্ত ফাঁক ফোকর দিয়ে রোদের আলোর আনাগোনা মুগ্ধ করল। বেশ কিছু ছবি তুলে,আবার “Canopy walk” করেই ফিরে এলাম। মিজানুর আবার সেই চেকপোস্ট এ আনল। পথে দেখলাম নন্দলাল দেবের মন্দির। ততক্ষণে সবারই ডান হাতের কাজের তাড়া পড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সৌমিত্রর সচিত্র পরিচয়পত্র ফেরত নিয়ে, নৃপেন্দ্রতে প্রত্যাগমন করা হল, চিংড়ি আর পার্সে তখন আমাদের অপেক্ষায়।
ফিরে এসে চব্য চষ্য আহার সারলাম। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে উঠলাম গিয়ে স্টীমারে। সূর্যাস্ত-রাইড। ইছামতীর এরূপ এ জন্মে ভোলার নয়। কে যেন এই রমণী শরীর আবির-রাঙিয়ে দিল। মুগ্ধতা একরাশ।প্রথম দিনাবসান।
২৭শে জানুয়ারি ২০১৮
এদিন আমরা গেলাম ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি ও খনা মিহিরের ঢিপি। ধান্যকুড়িয়াতে বেশ অনেকগুলি বনেদী বাড়ি আছে। তার মধ্যে গায়েনদের বাড়িটিই বেশী বিখ্যাত। সেখানকার ফুলের বাগানটি দেখার মতো। এদের আর একটি বাড়িতে একটি হোম তৈরি হয়েছে। সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।অন্য বাগানওয়ালা বাড়িটিতে খুব ধূমধাম করে দূর্গাপুজোও হয়। বেশ অনেকক্ষণ সময় কাটল ওখানে।
এরপর আমরা এলাম চন্দ্রকেতুগড়ে খনামিহিরের ঢিপি দেখতে। এই জায়গাটি নিয়ে বহু ঐতিহাসিকের বহু মত। “Another site more promising for excavation that the fort is mound known as Varaha Mihir’s house just to the north east of the Berachampa railway Station.’ – লিখেছিলেন লঙ হার্স্ট। তখন মার্টিন রেল কম্পানির স্টেশন ছিল বেড়াচাঁপায়। চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলের ওই অংশটি পরিচিত ‘খনা-মিহিরের ঢিপি’ নামেই। বলা হয়, গুপ্তবংশের সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের নবরত্নের অন্যতম, জ্যোতিষী বরাহের পুত্র মিহির ও পুত্রবধূ খনার বাসস্থান, গবেষণাগার ও মন্দির ছিল এখানেই। আশুতোষ মিউজিয়ামের নেতৃত্বে ১৯৫৬-৫৭ সালে এই অংশে খননের পর পাওয়া গেছে পোড়ামাটির পাত্র, পুঁথি, দামি পাথর, হাতির দাঁতের তৈরি নানাবিধ দ্রব্য, তামার মুদ্রা, পোড়ামাটির পুতুল, বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি। খননকারীরা জানিয়েছেন, এটি আসলে একটি মন্দির ছিল। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই মন্দিরের ভিত্তিভূমি ৩০০ ফুট দীর্ঘ, প্রস্থে ১০০ ফুট। চারপাশে ৬৩ ফুট বিস্তৃত এটি। ঢিপিটি খনন করে ৩৭টি ধাপবিশিষ্ট ইটনির্মিত সুদৃশ্য একটি গহ্বরও আবিষ্কৃত হয়েছে।(তথ্যাবলী: ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তন্ময় ভট্টাচার্য মহাশয়ের একটি ব্লগ)।এখানেই একটি ছোট গুমটি হোটেলে দুপুরের খাবার খাওয়া হল।
ইতিহাসের পাতা উল্টে টাকি ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ধ্যারতি দেখলাম।প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় সন্ধ্যারতি হয়। দেখার মতো। এটি টাকি ঢোকার মুখে অবস্থিত। যত্নে লালিত ফুলগাছ ও আবাসিকদের নিয়মানুবর্তিতা মনে দাগ কাটে। এক কথায় অপূর্ব। দ্বিতীয় দিনাবসান।
২৮শে জানুয়ারি, ২০১৮
এদিন সকাল থেকেই ফেরার তোড়জোড় শুরু হল।
পরীক্ষার আগে ‘লাস্ট মিনিট সাজেশানের’ মত, ‘লাস্ট মিনিট ঘোরা’তে বেরলাম। এদিন মিজানুর আসতে পারে নি। অন্য একজন এসেছিল। সেও বেশ অগাধ জ্ঞানী।
টাকি ইকোপার্ক যাওয়ার পথে একটি প্রশস্ত রাস্তায় সে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলে “আপনারা এখন ইতিহাসের পাতার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন।” মাথা তুলে তাকাতেই দেখি সামনে একটি ফলক। সেটিতে সত্যিই ইতিহাসের এক কাহিনী লেখা। এখানে হাতে সেটি না লিখে ছবিতে দিলাম (ছবি বিশেষ দ্রষ্টব্য)। ভেবে অবাক লাগলো, বাংলার আনাচে কানাচে এমন কত অশ্রুত, উপেক্ষিত ইতিহাসের ফলক নিশ্বাস ফেলে আর গ্রামের এই সরল মানুষ গুলি সেই কান ফিসফিস কথা সযত্নে লালন করে, এখানে না এলে অজানা রয়ে যেত। রোমাঞ্চের রেশ নিয়ে “মানসিংহ রোড” ধরে চললাম ইকো পার্ক।
পথে পড়ল মা কুলেশ্বরী মন্দির। ২০১৫ সালে টাকির শ্রীমদ স্বামী সর্ব্বানন্দ মহারাজ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরটির বৈশিষ্ট্য হল এখানে মা এর তিন রূপ একসাথে পূজিত হয়। তারা, কালী ও বগলা। নদীর পাড় থেকে সামান্য দূরত্ব এ এই মন্দিরটি। স্থানীয় লোকমুখে শোনা গেল অত্যন্ত জাগ্রত এটি।
ইকো পার্কে এলাম।প্রথমেই বলি কলকাতার ইকো পার্কের সাথে এর তুলনা না করাই ভাল। অত্যন্ত সাম্প্রতিককালে টাকি পৌরসভার মানসিংহ রোডের উপর গড়ে উঠেছে এই পার্কটি। একটি ছোট পাখিরালয় সেখানে বেশ কিছু দেশী ও বিদেশী পাখি, একটি মাছের অ্যাকোরিয়াম রঙবেরঙের মাছসহ, কিছু রাজহাঁস ও একটি বোটিং- যোগ্য জলাশয় এই পার্কের মূল দ্রষ্টব্য। এখানে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি কটেজ আছে। যারা নদীর পাড়ের কলকাকলি ও ব্যস্ততা তেমন পছন্দ করেন না, তাদের এই নিরিবিলি শান্ত কটেজগুলিতে থাকতে খুব ভাল লাগবে। অনলাইন বুকিং হয়। একটি ছোট Children’s Park ও আছে। খুদেদের খুব পছন্দ হবে। এই পার্ক প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা জনসাধারণের জন্য। কটেজের দিকের অঞ্চল ব্যারিকেড করা। অবশ্যই প্রবেশ নিষেধ। পার্কের প্রবেশ মূল্য ১০টাকা মাথাপিছু।
এই ইকোপার্ক যাওয়ার পথে এক গজা বিক্রেতার সাথে দেখা হয়। তিনি টোটো থামিয়ে আমাদের কিছু রসাস্বাদন করান তার নিজ সৃষ্টির। প্রসঙ্গত বলি, সম্প্রতি পুরীর একটি বিশেষ গজা খাওয়ার সুযোগ হয়। একটুও অত্যুক্তি না করে বলছি, টাকির এই বিক্রেতার গজা তার সাথে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে। আমরা বেশ কয়েকটি কিনেছিলাম। বিশেষভাবে কলকাতার জন্য প্যাক করে দিয়েছিল। Crispyness বাড়ি আসা পর্যন্ত একই ছিল।লোক টির হাসিমুখ, কলকাতার লোকেদের সন্তুষ্ট করে যে ভাললাগার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম তার মুখে তা অবিস্মরণীয়।
আরো দুটি জায়গার কথা ছোট্ট করে বলে নিই।
টাকিতে খুব সুন্দর প্রাচীন একটি দূর্গা দালান আছে। আমরা যখন যাই সেখানে একটি বাংলা সিরিয়ালের শুটিং এর তোড়জোড় চলছিল। হোমড়া চোমড়া প্রযোজক কিছু bouncer কে বাইরে বসিয়ে রেখেছিল। তারা ছবি তোলা এবং মূল স্থানে ঢোকা থেকে আমাদের অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিরত করে। আমাদের চালকের অনুনয় বিনয়ও ব্যর্থ হয়। আমার মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা ছিল।কিন্তু সৌমিত্রর কঠোর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে পারি না। অগত্যা খালি হাতে ফিরি। কিন্তু জায়গাটি অত্যন্ত মনোরম। মনে রয়ে যায়।
যে স্থানটির কথা বলে এইদিনের পর্ব শেষ করব, সেটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। এইদিন মিজানুরের পরিবর্তে যে টোটোচালকটি আমাদের ঘুরিয়েছিল সে কুলেশ্বরী মন্দির যাওয়ার আগে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল টাকি শ্মশানঘাটে। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। এখানে এখনো ইলেক্ট্রিক চুল্লি ঢোকেনি। সৌমিত্র আর তুলি টোটো থেকে নেমে পিছনে একটি ইঁটভাটায় ছবি তুলতে যায়। আমি আর টিনটিন বাহনে ছিলাম। একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছিল। কোন দিন কোন শ্মশান এভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। তখনই এই নতুন চালক নিয়ে এল একটি ফলকস্তম্ভের কাছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি কোন জওয়ানের জন্য উৎসর্গিত স্মৃতিফলক। চালক নিজেই ছবি তুলে এনে দিল। জানলাম এটি একজন অত্যন্ত অল্পবয়সী (২৫ বছর) সৈনিকের স্মৃতিফলক। কার্গিলে সে প্রথম পোস্টিং পায়। টাকির একটি গ্রামের ছেলে। যেদিন প্রথম বাড়ি আসবে বলে সে জানায় মা বাবাকে, সেদিনই সীমান্তে প্রতিপক্ষের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার শরীর। রবিঠাকুরের বাণীতে, জওয়ানের রাইফেল ও টুপিতে সদ্য প্রস্ফুটিত শহীদ সৈনিকের রক্তঘাম এখানে যেন চাক্ষুষ করলাম (ছবি বিশেষ দ্রষ্টব্য)।বর্ণনা শেষে বক্তার চোখে জল। একই গ্রামের ছেলে ছিল যে! “রাকেশকে জন্মাতে দেখেছি, দিদি।” সমব্যথী আমি সমবেদনার ভাষা পাইনা।টিনটিন আর আমি স্যালুট করলাম। ততক্ষণে সৌমিত্ররা এসে গেছে। চোখ মুছে চালক গাড়ি ঘোরাল।
নৃপেন্দ্রতে ফিরে সব জিনিস গুছিয়ে গাড়িতে তুললাম।ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, সব নদীর পাড়ের রোজনামচাতেই বোধহয় এরকম সুখ দুঃখের হাজারো গল্প লুকিয়ে থাকে, অবগুণ্ঠিতা। আমরা কংক্রিটের লোকজন মাঝে মাঝে এই নোনা গন্ধমাখা গল্পগুলো একটু নেড়ে চেড়ে দেখে যাই। মনে মনে তখন আমি যেন বলছি,
“আমি চাই ফিরে যেতে সেই গাঁয়ে
বাঁধানো বটের ছায়ে,
সেই নদীতীর হাওয়া ঝিরঝির
মনের গভীরে পড়ে থাকে যত স্মৃতি বিস্মৃতি
কখনো কি ভোলা যায়… ”
(ঘরে ফেরার গান,মহীনের ঘোড়াগুলি)
ছবিঃ সৌমিত্র মৌলিক