উৎসর্গ

 

বিশ্বজিৎ রায় ##

                                                             ( ১ )

আজ প্রায় ২৫-৩০ বৎসর পর অপ্রত্যাশিতভাবে আমার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী সুকান্তর একখানি চিঠি পেলাম। ক্ষুদ্র অথচ উদ্বেগজনক বয়ানে লেখা সেই চিঠি-

প্রিয় বিশ্বজিৎ,

আশা করি মঙ্গলময় ঈশ্বরের কৃপায় তোমরা সকলেই ভালো আছো। আজ হঠাৎ চিঠি পেয়ে নিশ্চয়ই ভাবছো এই ভবঘুরে আমার শান্তিপূর্ণ জীবনে আবার উদয় হলো কেন? তবে বলি, নিজ প্রয়োজনেই বহুদিন পর তোমার কথা মনে পড়লো। নিজ প্রয়োজনে বিশেষ মূহুর্তে কোনো  বিশেষ ব্যাক্তিকে স্মরণ করে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁর  স্মরণাপন্ন হওয়া- স্বার্থান্বেষী ক্ষুদ্র মনোবৃত্তির পরিচয় বহন করে, তবুও বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই যে এ বিষয়ে আমি একান্তই স্বার্থপর। আমি মনে করি সর্বদা সঠিকভাবে পাপ পূণ্য , ন্যায় অন্যায়  নির্ধারণ – কখনও কখনও  মানুষের বিচার্য ক্ষমতার উর্দ্ধে অবস্থান করে।  তুমি আমি সত্যই কী সেই বিচারকের ভার বহনে সক্ষম ? কোনো ক্ষুধার্ত feline প্রসবের পর  যদি ক্ষুধার তাড়নায় তার সন্তানকে হত্যা করে ভক্ষণ করে তবে তোমার আমার স্থুল দৃষ্টির বিচারে সে অন্যায়কারী, সে পাপী, কিন্তু তার বাঁচবার অধিকারকে জগতের কোনো ধর্মই অস্বীকার করতে পারে না। তাই  আমার স্বার্থপরতার বিচারের ভার তাঁর  উপর ছেড়ে দিয়েছি যিনি অনুপস্থিত হয়েও সর্বদা উপস্থিত , যিনি অলক্ষ্যে আমার সমস্ত কর্ম লিপিবদ্ধ করে চলেছেন অন্তিম পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দেবেন বলে। 

এ মূহুর্তে তোমার বিশেষ প্রয়োজন। স্বাক্ষাতে তোমায় সব জানাবো। প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

                                                                              ইতি

                                                                             সুকান্ত

সুকান্তর চিঠিটি পেয়ে আমি যতটা না আনন্দিত হলাম তার চাইতে চিন্তিত হলাম অনেক বেশী। সে নিজেকে ‘স্বার্থপর’ই বা বলছে কেন? আর কিসেরই বা সেই বিশেষ প্রয়োজন? কিছুই বুঝতে পারছি না,  তবে এটুকু অনুমান করতে অসুবিধা হলো না যে, সুকান্ত একটি বিশেষ দাবী নিয়েই আমার কাছে আসবে।

                                                                     ( ২ )

আষাঢ়ের  প্রথম সপ্তাহ । আজ সুকান্তর আসবার দিন। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । গ্রীষ্মে সূর্যের প্রখর তাপে প্রকৃতি যখন কোন চিত্র শিল্পীর দ্বারা ক্যানভাসে অঙ্কিত স্থির চিত্রের ন্যায় – স্থির, অস্তিত্বময় অথচ নিস্প্রাণ বলে জানান দিচ্ছিলো, সেই সময় বৈচিত্র্যহীনঅসাড় প্রকৃতির বুকে আষাঢ়ের প্রথম বারিধারার দৃশ্য উপভোগ করবার জন্য আমি জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম । জানালার সম্মুখের বৃহৎ শিমুল গাছটি বারিধারায় প্রাণভরে নিজেকে সিক্ত করবার আনন্দে মেতে উঠায়  তার ঠিক গুড়ির কাছেই গজিয়ে ওঠা কয়েকটিসন্ধ্যামালতী শিমুল গাছটির বড় বড় শাখা প্রশাখার দরুণ সেই পরম আনন্দ , আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে যেন মাথা তুলে শিমুলগাছটিকে অভিযোগের সুরে বলছে:

” তোমার বৃহৎ শাখা প্রশাখা সরিয়ে নাও, আমরাও মাতৃদুগ্ধ পান করে নব যৌবন লাভ করি।”

আমি সেই অভিযোগের দৃশ্যই অসহায় নীরব দর্শকের মত দাঁড়িয়ে দেখছিলাম । এমন সময় বাড়ির চাকরটি এসে আমায় বললো-

” বাবু, বাইরে একজন লোক আপনার খোঁজ করছেন। নাম বলছেন – সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ।”

আমি সঙ্গে সঙ্গে চাকরটিকে বললাম-

” যাও যাও এখনই তাঁকে ভিতরে নিয়ে এসো। আচ্ছা থাক, তোমায় যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি”-

এই বলে আমি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম । দেখি সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে আমার সুকান্ত । বয়স  প্রায় আমারই মত মধ্য চল্লিশের মত হবে, অথচ চোখ মুখে বার্ধক্যের স্পষ্ট ছাপ। গায়ে সাদা রঙের  একটি পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পাজামা, মাথা ভর্তি উসকো খুসকো  আধ পাকা চুল, দুই গাল ভর্তি দাড়ি গোঁফ,  চোখদুটি কোঠরাগত – চোখের নীচে রাতজাগা ব্যক্তির মত গাঢ় কালো দাগ, কাঁধে একটি ব্যাগ। সুকান্তর এই দশা দেখে   নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না, চোখে জল চলে এলো। আমি ছুটে গিয়ে সুকান্তকে জড়িয়ে     ধরলাম । তাঁর দুই হাত ধরে বললাম-

” চলো সুকান্ত , আমার ঘরে চলো।” – এই বলে সুকান্তকে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালাম।

সুকান্তর  সাথে খানিকক্ষণ বার্তালাপের পর আমি যা জানতে পারলাম তা হলো পশ্চিম     মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায়   সুকান্তর  একটি  অনাথ  আশ্রম  রয়েছে । জনা  বিশেক ছেলে মেয়ে ঐ আশ্রমে  থাকে। তার মধ্যে পায়েল নামে চার বছরের একটি মেয়ে রয়েছে, বর্তমানে সে হার্টের অসুখে ভুগছে, অস্ত্রোপচারের আশু প্রয়োজন । নানা দিক থেকে যেটুকু অর্থ সংগ্রহ করতে পেরেছে সেই অর্থ দিয়ে  কলকাতার, চেন্নাই-এর  অনেক স্বনামধন্য ডাক্তারকে দেখিয়েছে এবং সকলেরই একই বক্তব্য- অপারেশন জরুরী, নইলে পায়েলকে বাঁচানো সম্ভব নয় ।  কিন্তু ক্রমবর্ধমান চিকিৎসার খরচ আর ঐ অভাগা অনাথ শিশুগুলির দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগাবার জাতাকলে পড়ে বর্তমানে সুকান্ত কপর্দকহীন। অপারেশনের খরচ ৭ লাখ টাকা বহন করা তাঁর পক্ষে সাধ্যাতীত। যেহেতু আমি একজন হার্ট স্পেশালিস্ট তাই সুকান্ত আমারকাছে ছুটে এসেছে ।

সুকান্তর মুখে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে এবং তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে আমি বললাম-

” তুমি নিশ্চিত থাকো সুকান্ত । তোমার পায়েলের অপারেশনের সমস্ত দ্বায়িত্ব আমি নিলাম ।     আমাদের মধ্যে এখনও অনেকেই রয়েছেন  যারা আজও নিঃস্বার্থভাবে নিঃশব্দে মানবসেবা করে    চলেছেন । আমি তাদের দলে নই, তবে তুমি যে আমাকে এ মহৎ কাজের যোগ্য ভেবেছো তার জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ ।”

আমার প্রতিশ্রুতি শুনে সুকান্ত যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে আমি এত সহজে রাজী হয়ে যাব। একে তো হাসপাতালের ডাক্তার আমি, সাথে সাথে নিজস্ব নার্সিংহোম রয়েছে, এছাড়া লেখালেখির সুবাদে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য দেবার জন্য বিভিন্ন  সেমিনারে অংশগ্রহণকরতে হয় , সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে হয় – এক কথায় সারাদিন আমার চরম ব্যাস্ততার মধ্যে কাটে। সমাজসেবা করবার অবকাশ কোথায় ? তাই সুকান্ত আমার হাতদুটি চেপে ধরে বললো-

“আমি জানতুম তুমি আমায় নিরাশ করবে না।, তুমি আমায় নিশ্চিত করলে বিশ্বজিৎ । তবুও বলি, তুমি তোমার কথা রাখবে, তো ? তুমি তো নানা রকম কাজে ব্যস্ত থাকো। মেকি স্বভাবকে আমি বড় ঘৃণা করি।”

আমি বললাম:  “কথা যখন দিয়েছি,  তোমার পায়েলকে আমিই  সুস্থ করে তুলবো। কথার  নড়চড় হবে না। মানুষের জীবনের উপরে কিছু হতে পারে না- খ্যাতি, যশ, অর্থ কোন কিছুই নয়। আমার নার্সিংহোমেই পায়েলের অপারেশন হবে এবং আমি  কথা  দিচ্ছি  আগামী ১৯শেজুন পায়েলের অপারেশন করবো । “

                                                                        ( ৩ )

আজ ১০ই জুন। আগামী ১৯শে জুন পায়েলের অপারেশনের আয়োজন করা হয়েছে । কিন্তু – ” Man proposes, God disproposes” । দুই দিন পূর্বে লন্ডন থেকে এক রেজিস্ট্রার চিঠি এসেছে Queen Mary University তে WHRI Research Seminar-এ যোগদান করবার অনুরোধ  জানিয়ে । তারিখ- ঐ ১৯শে জুন । শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানে অবদানের জন্য আমাকে বিশেষ  সম্মানে সম্মানিতও করতে চায় । এখন সমস্যা হলো আমি যদি লন্ডনে যাই, তাহলে পায়েলের অপারেশনের কি হবে? কিছু দিন আগেই আমি পায়েলকে দেখে এসেছি – অবস্থা ভালো  নয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন দরকার । আবার যদি না যাই তাহলে এতবড় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবো । আমি পড়লাম দোটানায় । ভাবছি কি করা যায় ? এমন সময় আমার ছাত্র ও  আমারই নার্সিংহোমের জুনিয়র ডাক্তার অর্ণব আমার চেম্বারে এসে আমাকেঅভিনন্দন জানিয়ে   বললো-

” আপনার সুসংবাদটি আমরা সকলেই পেয়েছি Sir । আপনি সেমিনারে যাচ্ছেন তো ?”

আমি বললাম- ” ধন্যবাদ অর্ণব । কিন্তু কি করা যায় বলো তো ? ১৯ তারিখেই আবার পায়েলের অপারেশন রয়েছে। আমি কথা দিয়েছি, তা ছাড়া মেয়েটির অবস্থাও ভালো নয়।”

আমার কথা শুনে অর্ণব বললো-

” অপারেশন কিছুদিন পিছিয়ে দিলেই হবে । আপনি যেতে পারেন । আমরা তো আছি। কোনো রকম critical situation হলে আমরা সামলে নেবো।”

অর্ণবের কথায় আমি ভরসা পেলাম কেননা অর্ণব এই বয়সেই heart specialist  হিসাবে যথেষ্ট নামডাক অর্জন করেছে । মনে মনে ভাবলাম সেরকম পরিস্থিতি হলে সামলে নিতে পারবে । তাছাড়া বেশি দিনের ব্যাপার তো নয় , ফিরে এসেই অপারেশন করা যাবে । অর্ণব তো রয়েছে।  তাই যাওয়ায় মনস্থির করলাম ।

লন্ডন থেকে ফিরে এসেই নার্সিংহোম ছুটলাম । অর্ণবের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সুকান্ত   নির্ধারিত দিনেই পায়েলকে নিয়ে নার্সিংহোমে এসেছিল, কিন্তু অর্ণব কিছু ওষুধপত্র দিয়ে পায়েলকে  ফিরিয়ে দেয় এবং আমি না আসা পর্যন্ত অপারেশন সম্ভব নয় বলে জানিয়েও দেয়।

পরের দিনই আমি রওনা হলাম সুকান্তর আশ্রমের উদ্দেশ্যে। আশ্রমটি খুব বড় নয়- টিনের ছাওনি, খলপাড়ের বেড়া দেওয়া গোটা কয়েক ছোট ছোট ঘর, এবং উপরে খড়ের ছাওনি দেওয়া চতুর্দিক খোলা একটি উপাসনালয়। আশ্রমের সামনে কিছু ফুল ও সব্জীর চাষ করাহয়েছে । দেখি তিন- চারটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ফুলগাছগুলি পরিচর্যা করছে। আমি তাদের মধ্যে থেকে একজন ডেকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম-

“পায়েল কেমন আছে ?”

ছেলেটি বললো – ” পায়েল নেই “।


মনের মধ্যে অশুভ আশঙ্কায় আমার হাত পা হীম হয়ে এল। আমি টেনশনে উত্তেজিত সুরেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম –

” নেই মানে? কি বলছো তুমি ? কোথায় গেছে ?”

আমার কথা বলার ধরণ দেখে এবং একসঙ্গে এতগুলি প্রশ্ন শুনে ছেলেটি রীতিমত ভয় পেয়ে গেল ।  চুপ করে রইলো।

নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম-

” ঠিক আছে, তোমাদের গুরুদেব কোথায় ?”

ছেলেটি আমায় ঈশারায় একটি ঘর দেখিয়ে দিল। ঘরে গিয়ে দেখি সুকান্ত মেঝেতে মাদুর পেতে বসে কি যেন লেখালেখি করছে । আমার পায়ের শব্দ শুনে সুকান্ত মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো ঠিকই কিন্তু কোন কথা না বলে পুনরায় লেখতে আরম্ভ করলো । এমন তাচ্ছিল্যউদাসীন ব্যবহারে আমি  ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম এবং কিছুটা অভিমানের সুরেই আমি সুকান্তকে বললাম-

” সুকান্ত, কি বলছে তোমার ছেলেমেয়েগুলি ! পায়েল নেই, কোথায় পাঠিয়েছো ? আমি তো বলেছিলাম  আমিই পায়েলের চিকিৎসা করবো। আমায় বিশ্বাস করতে পারলে না ?”

সুকান্ত ঝড়ের গতিতে আমার দিকে ছুটে এসে সজোড়ে আমার গালে একটি চড় কষিয়ে রাগে ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে বললো-

” বিশ্বাস ! ……………. মানুষকে রক্ষা করবার জন্য যেমন ঈশ্বর এগিয়ে আসেন তেমনি ঈশ্বরকে রক্ষা করবার জন্যও কখনো কখনো মানুষকেও এগিয়ে আসতে হয় । তোমরা বাঁচতেও শিখলে না।”

চরম অপমানিত হয়ে ঘর থেকে বের হবার সময় দেখি ঘরের পশ্চিমদিকের একটি কাঠের খুটিতে  পায়েলের একটি ছবি টাঙানো রয়েছে- তবে ছবিটিতে  একটি টাটকা রজনীগন্ধার মালা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − seven =