এক প্রধানের ডেরায় এক  রাত

সুমেধা চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা

তাকদা জায়গাটির নাম আজও অনেকের অজানা। যাওয়া আসার টিকিট কাটার পর যখন তাকদাতে রাত কাটাব ঠিক করলাম, তখন প্রায় সব ক’টি হেরিটেজ বাংলো এ খোঁজ করি। একটিও খালি পাইনি পছন্দের দিন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ গাড়ি দিতে পারছেন না দশেরা বলে। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা তাকদাতে থাকবই। এমত পরিস্থিতিতে প্রথম কথা হল সরণ প্রধানের সাথে। অত্যন্ত মিষ্টভাষী এবং দায়িত্বপরায়ণ প্রধানজী।  বাংলো ৩৬ কে ‘প্রধাণ হোমস্টে’ রূপে অত্যন্ত যত্নে পালন ও লালন করেন। উনি আমাকে রাতযাপন এবং গাড়ি দুইই দিলেন এবং এই টিকিট কাটার পরবর্তী চারমাস প্রায় দুতিন দিন অন্তর প্রায়ই খবর নিতেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকলাম।

এবার একটু তাকদার গল্প বলেনি। ‘তাকদা’ কথাটি এসেছে একটি লেপচা শব্দ ‘তুকদা’ থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘কুয়াশা’। এই নামের কারণ প্রায়ই এই সমগ্র জায়গাটি ‘কুয়াশাচ্ছন্ন’ থাকে।
দার্জিলিং থেকে ২৮কিমি দূরে,  ৪০০০ ফুট উচ্চতায় এক শান্ত, সুন্দর, চা বাগান ও জঙ্গল ঘেরা জনপদ তাকদা। কুয়াশামাখা পাকদণ্ডী,  পাখিদের কলতান, ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটাপথ, একাধিক পাহাড়ি ঝর্ণার অবিরত বয়ে চলার আওয়াজ তাকদার ‘USP’।
ঊনিশের দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট গড়ে ওঠে তাকদাতে। এই সময়ে বেশ কিছু  সিনিয়র অফিসাররা এই জায়গা পরিদর্শনে আসতেন প্রায়শই।  এরই ফলস্বরূপ এখানে প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি ব্রিটিশ বাংলো গড়ে ওঠে। এগুলির সবই অন্তর্সজ্জা একদম ব্রিটিশ ধাঁচের এবং একই রুচিসম্পন্ন।  এরপর ইংরেজরা যখন এদেশ ত্যাগ করে তখন এই বাংলোগুলি নিলাম হয়, যার মধ্যে বেশির ভাগই এখন ‘হেরিটেজ বাংলো’ বা ‘হোমস্টে’  হিসেবে বহু স্থানীয় মানুষের জীবিকার্জনের উৎস। বেশ কিছু স্কুলও হয়েছে এই বাংলোগুলিতে। এই পর্যন্ত পড়াশুনো করার পর এবং নেটে অপূর্ব কিছু ছবি দেখে এখানে রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নিই।


রামধুরা থেকে লামাহাট্টা ও তিনচুলে ঘুরে তাকদার দিকে যখন রওনা দিলাম, তখন প্রায় দুপুর। তাকদা যাওয়ার রাস্তাটি সারানো চলছে তাই বেশ বন্ধুর, কিন্তু প্রাকৃতিক শোভা মন ভরিয়ে দেয়। বিভিন্ন প্রজাতির পাইন গাছের মধ্য দিয়ে রাস্তা,  মাঝে মাঝেই মেঘ ও কুয়াশা এসে ঘিরে ধরছে আর অসীম দক্ষতায় প্রধানজী প্রেরিত আমাদের ড্রাইভার দীপেন পাকদণ্ডী বেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, মাঝে মাঝে hairpin loop প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি bending। তাকদা বাজার থেকে বেশ খানিকটা নীচে নেমে বাঁদিকে গেট লাগানো একটি ‘ খাদের’ ধারে এসে দীপেন বলে কিনা ‘ লিজিয়ে, বাঁয়ে হ্যায় আপকা হোমস্টে’। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বাঁদিকে তো খাদ, এর মধ্যে বাংলো কই? তারপর আবার চমক, দেখি ঐ খাদ থেকে হাত জোড় করে উঠে এলেন প্রধানজী। সরণ প্রধান। ছবি দেখেছি, ফোনে কথা হয়েছে তাই চিনতে অসুবিধা হল না। এবার গেট খুলে খাদে মুখ বাড়িয়ে দেখি, প্রায় ২০ – ২৫টি  পাকদণ্ডী সিঁড়ি নেমে ঘন পাইন জঙ্গলের মধ্যে দুটি অপূর্ব বাংলো।  আমাদের ঠাঁই হল তারই একটিতে। এক লহমায় সব ক্লান্তি উধাও। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ। বিভিন্ন ঘরফেরতা পাখির কথোপকথন।  আর সবচেয়ে মনে রাখার মতো সারাক্ষণ একটি অদৃশ্য ঝরণার আওয়াজ। এই ধ্বনিমূর্ছনা মাতাল করল নিমেষে। ডাক পড়ল দুপুরের খাবারের। সে এক এলাহি আয়োজন। বাঙালী অতিথিদের জন্য প্রধানজী বিশেষ বাজার থেকে টাটকা মাছ এনেছেন, আর যে পদটি ভাবিজী রেঁধেছেন তার  স্বাদ ভোলবার নয়। তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে তখন বেশ। পাখিদের ঘরে ফেরার গান আর ক্রমাগত ঝর্ণার কুলু কুলু ধ্বনির মাঝে কখন যেন চোখটা লেগে এসেছিল। রাতে দুর্দান্ত একটি আচার সহযোগে চিকেন খাওয়া হল। অতঃপর রাত্রিযাপন সেই ঝর্ণার আশ্লেষ আদর মেখে।


পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙল।  কতরকম যে পাখির ডাক!! বাংলোর ছাদের কাছে একটি ছোট্ট কাঁচের জানালা, যা দিয়ে নরম রোদের আলো এসে আমাদের বিছানায় পড়ল। সে এক অপার্থিব পরিবেশ। বেড-টি এল। এদিন আমাদের ফেরা। ঠিক হল তিনটি চা বাগান- ‘ রংলি-রংলিয়ট’ ‘গেলি’ ও ‘তিস্তা ভ্যালী ‘ দেখে দীপেন আমাদের এন জে পি তে ড্রপ করবে। আজ এখানে সবার বাড়িতে দশেরা উৎসব।  দীপেনকেও ফিরতে হবে বাড়ি তাড়াতাড়ি। তাই সকাল ন’টায় ডাক পড়ল  প্রাতরাশ এর। অত্যন্ত যত্নে খাওয়ালেন পুরি- সব্জি। স্বাদ অতুলনীয়। প্রধানজী প্রতিবার নিজে পরিবেশন করে খাওয়াতেন।বসে থাকতেন আমাদের সাথে টিনটিন এর শেষ ভাত না ওঠা পর্যন্ত। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। খাদা সহযোগে বিদায় দিলেন।টিনটিন এর জন্য আবার আলাদা রং। বার বার বললেন আবার যেন যাই। বললেন খাদা পরানোর সময়ে, ‘ অপরিচিত ছিলাম, তাও তো কথা হত প্রায়ই, সেই আসা সমাপ্ত, যোগাযোগ যেন থাকে।” মন খারাপ হল খুব। ফিরে আবার সেই রুটিন জীবন। উপরে গাড়ি পর্যন্ত এলেন দুজনই। বলে দিলেন ‘যেখানে যেখানে ফটো তুলতে ইচ্ছা করবে পথে সেখানে সেখানেই থামাবেন দীপেনকে, কোন অসুবিধা নেই…দীপেনকে বলা আছে’। ফেরার পথে প্রথম পড়ল ‘ রংলি – রংলিয়ট’ চা বাগান। অপূর্ব একটি বাংলো আছে। মেঘের আস্তরণের আড়ালে বিস্তৃত চা-বাগান ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগল। এরপর এল ‘Gielle’ টি-এস্টেট। ধাপে ধাপে নীচে নেমেছে…. আলতো সৌন্দর্যে। ছবি উঠছে।  শেষে পড়ল সুন্দরী ‘ তিস্তা-ভ্যালি’। যতদূর চোখ যায় বিস্তৃত সবুজ। এবার মন খারাপটা জাঁকিয়ে এল। চা এর গাছরা, ‘আলতুসি’ মেঘেরা যেন কান ফিসফিস করে কপালে আদরের রেখা রেখে গেল  ‘আসিস কিন্তু আবার’।


মহানন্দা  Wildlife Sanctuary র মধ্যে দিয়ে দীপেন গাড়ি ছোটাল বেগে, দূরে পাহাড়ের রেখা তখন প্রায় বিলীন। এনজেপি তে নামিয়ে সব মাল পত্র হাতে গুছিয়ে দিয়ে দীপেন ছেত্রী হাত জোড় করে বললো
‘কথা হবে দিদি, number তো রইল। ‘জানি এটা শুধুই প্রশস্তিবাক্য, কিন্তু উষ্ণতায় মন ভরে গেল। রাতে ট্রেনে উঠে ছবিগুলো দেখছিলাম। তারই ক’টা দিলাম এখানে। কানে তখনও আদরমাখা, চা- পাতার গন্ধযুক্ত ফিসফিসানি ‘ আবার আসিস’।

 

থাকা খরচ: ১৫০০/- ( প্রতিদিন রুম প্রতি)
খাওয়া খরচ: ৬০০/- প্রতিদিন মাথাপিছু

পুনশ্চ : প্রধানজীর এখানে একটি বিশেষ surprise থাকে ওনার বিশেষ পছন্দের লোকেদের জন্য। আমরা অভিভূত হয়েছিলাম। ওনার বিশেষ একটি শখ, যা এখানে ফিরে আসতে বাধ্য করবেই।

যোগাযোগ: সরণ প্রধান (9593640577)

ছবি: সৌমিত্র ও প্রধানজী।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − three =