খেলা বৃত্তান্ত
শান্তনু দত্ত, ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি ##
আজ থেকে প্রায় ১৫-২০ বছর আগে পর্যন্ত বহু খেলার সাথে ভালবাসা ছিল, সম্পর্ক ছিল। খেলাগুলোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলাম তখন। আজও যে নেই তা নয়। এখন অনেক খেলাই খুঁজে পাই না। আসলে আমরা আজ এমন সময়ে এসে পড়েছি যেখানে খেলাগুলো এলোমেলো ভাবে অযত্নে হারিয়ে যেতে বসেছে। অনেক খেলা হারিয়েও গেছে। স্মৃতির পাতা যখন উল্টে দেখি আমাদের ছেলেবেলার সাথে এখনকার ছেলে মেয়েদের ছেলেবেলার কোনো মিল খুঁজে পাই না।
আমাদের ছেলেবেলার দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল। এখনকার মতো মোবাইল, ট্যাব আমাদের হাতে ছিল না। আসলে তখন এসবের অস্তিত্ব ছিলই না। বিদ্যালয় বাদে খেলার মাঠটাই ছিল সবচেয়ে প্রিয়। বিদ্যালয়ে খেলার পরিবেশটাও ছিল খুব ভালো। বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে পা না পড়লে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে না থাকলে কিংবা খেলার মাঠে খেলাটা অনুভব না করলে দিনটা মনমরা হয়ে যেত।
আমাদের বাড়ির পাশে একটা খেলার মাঠ আছে যেখানে খেলার কোনো অন্ত ছিল না। সব ধরনের খেলাই সেখানে চলত। ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন সময় অনুসারে এক এক ঋতুতে হতো। এখন সেই মাঠ দেখলে চোখে জল চলে আসে। যখন দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলটা আমাদের খেলার মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তো, খেলার আর কোনো জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকতো না, তখনও আমরা পাড়ার অলিতে গলিতে কিংবা আশেপাশের কোনো ক্ষেতে খেলা চালিয়ে যেতাম। খেলা ছাড়া রাতের পড়ায় মন বসত না, ঘুমটাও ঠিক আসত না। খেলা না থাকলে মাঝে মাঝেই বিকেলে সাইকেলে চেপে ঘুরতে বেড়িয়ে পরতাম, মনটাও ভালো থাকতো আর শরীরটাও।
কিন্তু এখন, খেলার মাঠ একা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে। মাঠে খেলার গন্ধ পাওয়া যায় না, খেলার মতো মানুষের খোঁজ পাওয়া খুব মুশকিল আজকের দিনে। খেলা এখন মোবাইল ফোনে, কম্পিউটারে কিংবা ল্যাপটপে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠ জুড়ে অট্টালিকা নতুন প্রাণ নিয়ে জেগে উঠছে। আসলে খেলাগুলো মরুর বুকে হারিয়ে যাওয়া গাছ হতে চলেছে। আমরা যদি তা ধরে রাখতে না পাড়ি সমাজটাও কৃত্রিম হয়ে উঠবে আর খেলাগুলো একে একে ঠাঁই পাবে ইতিহাসের পাতায়।
মানুষের শরীরে আজ রোগ ব্যাধি বেড়েই চলেছে। তার অনেকটাই এই খেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ফলে। হা-ডু-ডু, কবাডি, লুকোচুরি, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, খো-খো, কুমির ডাঙা, মার্বেল খেলা, লাটিম এসব খেলা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে বাংলার বুক থেকে। গ্রাম বাংলার খোলা মাঠ ঘাট আজ ভরে যাচ্ছে বসতিতে। খেলার মাঠ যেগুলো আছে তাও আর ভরে ওঠে না ছেলে মেয়েদের হই-হুল্লোরে।
সেকালে ছেলেমেয়েরা কতই না পাগল থাকত খেলার জন্যে। কিন্তু একালে মানুষের মন থেকে যেন খেলার মাঠে যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। সব আজ ইলেকট্রনিক্সে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। শৈশবটা আটকে পড়ছে মোবাইল ফোনে। পরিবারের সদস্যরাও শিশুদের আটকে রাখছে গৃহের সীমানায়। পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে তাই আজকালকার ছেলেমেয়েরা অপারক হয়ে পড়ছে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা খোলামেলা ভাবে খেলতে পারছে না, একে অপরের সাথে মিশতে পারছে না। তারা আজ গৃহবন্দি। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন আর দূরে নেই যেদিন শুধু সংরক্ষিত মাঠ ছাড়া আর কোনো খেলার মাঠ পড়ে থাকবে না। হাতে গোনা কয়েকটি খেলা ছাড়া সব খেলাই ঠাঁই পাবে ইতিহাসের পাতায়।