দন্ডমহোৎসাব বা চিঁড়ের মেলা

শুভজিত দত্ত, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

প্রতিবছর  জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে পানিহাটিতে আয়োজিত হয় একটি প্রাচীন উৎসব বা মেলা যা ‘দন্ডমহোৎসব’ বা ‘চিঁড়ের মেলা’ নামে পরিচিত।পানিহাটির শ্রীচৈতন্য স্মৃতি বিজড়িত মহোৎসবতলা ঘাটে প্রায় পাঁচশ বছর আগে এই মেলা শুরু হলেও বর্তমানেও এই মেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।কিন্তু কেনই বা এই মেলার নাম ‘চিঁড়ের মেলা’ বা ‘দণ্ডমহোৎসব’ কাকেই বা দণ্ড দেওয়া হয়েছিল?

কৃষ্ণদাস কবিরাজের  চৈতন্যচরণামৃত অনুসন্ধান করে অবশেষে এর উত্তর পেলাম। এই মেলার ইতিহাস জানতে গেলে অনেকটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় পঞ্চদশ শতকে। এই সময়ে সপ্তগ্রামের শাসনভার ন্যস্ত ছিল হিরণ্যদাস মজুমদার ও গোবর্ধন দাস মজুমদারের হাতে। সপ্তগ্রামের  কৃষ্ণপুরের জমিদার গোবর্ধন দাস মজুমদারের একমাত্র পুত্র ছিলেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী (১৪৯৮),যিনি পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের ষড় পার্ষদের এক অন্যতম পার্ষদ ছিলেন।

বালক বয়স থেকেই তিনি মহাপ্রভুর অপ্রাকৃত মহিমার প্রতি আকৃষ্ট হন। যখন হরিদাস ঠাকুর বলদেব আচার্যের বাটিতে পদার্পন করেন, তখন থেকেই ওনার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে মহাপ্রভুকে দেখার জন্য।  অবশেষে মহাপ্রভু যখন শান্তিপুরে  এসেছিলেন তখন পিতার অনুমতি নিয়ে তিনি তাঁর দর্শনে যান। এখানে সাত দিন থাকার পর ওনার ঘর সংসার আর ভালো লাগতো না।  কিন্তু মহাপ্রভু তা বুঝতে পেরে ওনাকে বাড়ি ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। তিনি প্রভুর আদেশ মেনে বাড়ি ফিরে এলেও ওনার মনের মধ্যে সদা জাগ্রত ছিল আরও ব্যাপকভাবে মহাপ্রভুর সান্নিধ্যলাভের আকুলতা ও সেবা করার অভিলাষ। এই কারণেই তিনি ইন্দ্রের মতো বিপুল ঐশ্বর্য   ও অপ্সরার মতো সুন্দর পত্নীকে হেলায় পরিত্যাগ করে বারবার বাড়ি থেকে পালিয়ে ছুটে যেতেন মহাপ্রভুর কাছে। কিন্তু প্রভু প্রতিবারই বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দেন। শেষবার নীলাচলে মহাপ্রভুর সাথে দেখা হলে প্রভু বলেন-নিত্যানন্দ হচ্ছেন আদি গুরু তাই শ্রীচৈতন্য কে পেতে গেলে শ্রী নিত্যানান্দের মাধ্যমেই পেতে হবে।

জনশ্রুতি আছে রঘুনাথ দাস গোস্বামী এই বাড়ি ফেরার খুশিতে পিতা গোবর্ধন দাস একবার গ্রামের সবাইকে মাছ ভাত খাওয়ান। এখনও সপ্তগ্রামের কৃষ্ণপুরে প্রতিবছর ১ লা মাঘ এক মেলার আয়োজন করা হয় এই উপলক্ষ্যে। যা মৎস্য মেলা নামে খ্যাত।

কিন্তু বিবাগী মানুষের মন কি বাড়িতে বেশিদিন থেকে। ১৫১৭ সালের  জৈষ্ঠ্য শুক্লা ত্রয়োদশীর দিনে শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভু যখন পানিহাটির গঙ্গাতীরে ভক্তপরিবৃত হয়ে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছিলেন সেই সময় রঘুনাথ দাস গোস্বামী বাড়ি থেকে পালিয়ে পানিহাটিতে আসেন এবং দূর থেকে নিত্যানন্দ প্রভুকে দণ্ডবৎ প্রনাম করেন।রঘুনাথ দাস গোস্বামীর এই আগমণের খবর যখন নিত্যানন্দ প্রভু পান,তখনই তিনি বলে ওঠেন-“ওরে চোরা! এতদিনে দর্শন দিলি! আয়, আয়, আজ তোরে দন্ড দেব।”  নিত্যানন্দ প্রভুর ডাকেও রঘুনাথ গোস্বামী সংকোচে সাড়া না দিলে তিনি তাঁকে জোর করে কাছে টেনে এনে তাঁর মাথায় তাঁর শ্রীপাদস্পর্শ করে তাঁকে কৃপা করেন এবং বলেন-

নিকটে না আইস চোরা ভাগ দূরে দূরে।

আজি লাগি পাইয়াছি দন্ডিব তোমারে।।

দহি চিড়া ভক্ষণ করাহ মোর গনে।

শুনিয়া আনন্দ হৈল রঘুনাথের মনে।।”

এই নির্দেশ পেয়ে তিনি বৈষ্ণব সেবার অধিকার অর্জনের পরমানন্দে গ্রামে গ্রামে লোক পাঠিয়ে সংগ্রহ করলেন চিঁড়া, দই, দুধ, সন্দেশ, চিনি, কলা এবং একটি মাটির গামলায় তা মিশ্রণ করে সবাইকে সেই প্রসাদ বিতরণ করেন এবং এই মহাউৎসবের সূচনা করেন। এই ভোজন উৎসব দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের বনভোজন লীলায় তার সখাগণ চারিদিক থেকে মিলিত হয়েছে।কথিত আছে এই উৎসবের সময় অলৌকিক ভাবে স্বয়ং মহাপ্রভুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই থেকেই এই উৎসব দণ্ডমহোৎসব বা চিড়ের উৎসব নামে খ্যাত,যা প্রতিবছর এই শুভতিথিতে পানিহাটির গঙ্গাতীরে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়ে থাকে। বৈষ্ণব সেবা ও শ্রীকৃষ্ণের লীলা স্মরণের উপযোগী এমন তাৎপর্যপূর্ণ উৎসবে স্বয়ং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব দু দুবার এসেছিলেন। ১৮৮৩ সালের মেলায় ঠাকুরের অদ্ভুত নৃত্য এবং ১৮৮৫ সালে মনিসেনের পারিবারিক দীক্ষাগুরু নবদ্বীপ গোস্বামীর সাক্ষাতের সেই অন্তরঙ্গ বর্ণনা কথামৃতে পাওয়া যায়।

এবছর এই উৎসব  31শে জ্যৈষ্ঠ (১৫ই জুন) অনুষ্ঠিত হবে।মেলা ছাড়াও আপনারা ঘুরতে পারেন ইসকনের মন্দির,শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতিবিজড়িত পানিহাটি পাটবাড়ি(রাঘব পন্ডিতের বাড়ি)। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত মনি সেনের বাড়ি।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: অমিতাভ পুরকায়স্থ

তথ্যসূত্র:আগরপাড়ার ইতিহাস-চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়।

পানিহাটি পরিক্রমা-কৃশানু ভট্টাচার্য।

চৈতন্যচরণামৃত-কৃষ্ণদাস কবিরাজ।

এবং মৌ কয়াল

2 thoughts on “দন্ডমহোৎসাব বা চিঁড়ের মেলা

  • June 12, 2019 at 2:12 pm
    Permalink

    বাহ! অনেক কিছু জানতে পারলাম।
    ধন্যবাদ।

    Reply
  • June 12, 2019 at 5:28 pm
    Permalink

    ধন্যবাদ।সময় পেলে এবারের উৎসবে ঘুরে যেতেন পারেন।আশা করি ভাল লাগবে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen + ten =