দীঘায় দুদন্ড

কাকলি সরকার (নীপা), গোবরডাঙ্গা, উত্তর ২৪ পরগনা 

 

প্রতিদিনের একঘেয়ে আর ক্লান্তির ফাঁকে মন যদি দুদন্ডের অবসর চায় তাহলে খুব দূরে নয়, এক দৌড়ে যেখানে পৌঁছানো যায় তার নাম ‘দীঘা’। রোজ ৩ বার খাবার গ্রহণ করেও আমাদের যেমন ফের খিদে পায়, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে খাবারে যেমন কখনই অরুচি আসে না তেমনি প্রতিবার দীঘা ঘুরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই আবার হৃদয়ে দীঘা দেখবার তৃষ্ণা জাগে। তার স্বাদ নতুন করে পাওয়ার খিদে জাগে ভ্রমণ পিপাসু পরাণে। তবে ‘শঙ্করপুর’ ও মন্দারমনিকেও অগ্রাহ্য করা চলে না।

সমুদ্রমাতা দুহাত প্রসারিত করে আছেন এখানে। বহু হোটেল কেবল পায়ে হাঁটবার দূরত্বে। অনলাইনে বুক করা ছিল আমাদের ‘যুব আবাস’-এ। ট্রেন এবং বাস দু ভাবেই আসা যায় এখানে। সকলেই অবগত আছেন। কলকাতা থেকে ভোর ৫ টায় আমরা বেরিয়ে পড়ি, কোলাঘাটে টিফিন সেরে যখন আমরা দীঘায় এসে পৌঁছালাম তখন বাজে প্রায় ১২ টা। হোটেলে ঘরের মধ্যে তখন গরম জলের গীজার/এ.সি.। কিন্তু এ ঘরের চেয়ে বড় আকর্ষণ তখন সমুদ্র। তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় আদিগন্ত বিস্তৃত বেলাভূমি যেন উদ্বেল হয়ে আছে। কোনটা আকাশ, কোনটা জল, কোনটা মাটি আলাদা করে বোঝার অবকাশ নেই কোন। যতদূর চোখ যায় কেবল ধূসর জল আর জলের কল্লোল ধ্বনি। সময়টা ছিল নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। এটাকে এখানে বলে ‘অফসিজন’। তাই লোকজন বেশ কম। হালকা শীতের আমেজ গায়ে মেখে রোদ্দুরে পিঠ ঠেকিয়ে বসলে কখন যেন কেটে যায় দীর্ঘ দগ্ধ দুপুর। ভুলে যাওয়া যায় জীবনের সমস্ত জটিলতা পঙ্কিলতা। তার পর কখন এক সময় সকলকে স্নান করতে দেখে আপনি আর স্থির থাকতে পারবেন না। কখন যেন নেমে পড়বেন সমুদ্রের সফেন জলে। অন্য সকলের মত শুরু করবেন জলকেলি। ঠিক যে ভাবে বৃন্দাবনে কানাই করেছিলেন বহু বছর আগে। সমুদ্রের কল্লোল ধ্বনি আর মানুষের কোলাহল মিলে মিশে এক অদ্ভুত কলতান সুদীর্ঘ নির্জনতার বুক চিরে আপনার কর্ণগোচর হবে। কলকাতার যানবাহনের কোলাহল থেকে একেবারে অন্য রকমের। এক অদ্ভুত আবেশে ভেসে যাবেন আপনি।

এরপর স্নান সেরে হোটেলে ফেরা, সেখানে খাওয়া সেরে নিয়ে পুনরায় ফিরে আসা সমুদ্র সমীপে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তখনও সে বলে চলবে ‘ভিজবে এস’ ‘ভিজিয়ে দেব নাকি?’। ততক্ষণে দূরে দিগন্তে তাকিয়ে দেখবে কামরাঙা রঙের মেঘকে ফাঁকি দিয়ে সূর্যদেব যেন ডুবতে বসেছে। মূহুর্তে মনে হবে ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা এড়িয়ে সে বুঝি আশ্রয় নিতে চলেছে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউ বনের কিনারে। আপনি হয়তো ক্যামেরাবন্দী করতে চাইবেন তার ‘মোহনীয় মহিমা’। কিন্তু সে কেবলই আপনাকে মোহিত করে দিয়ে ক্ষান্ত হবে। ক্যামেরায় স্ববেশে ধরা দেবে না। আস্তে আস্তে নেমে আসবে তন্দ্রসমা সন্ধ্যা। জীবনানন্দের ভাষায় ‘বাংলার অনুগত নীল সন্ধ্যার’ মতোই সে তোমার চোখের পরে, মুখের পরে ছড়িয়ে দেবে তার ‘কালো চুলের অজস্র চুমা। হঠাৎ দেখবে চা ওয়ালা। গরম চা কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তোমার সমুখে। আসবে ঝিনুকের মালা হাতে নিয়ে গ্রাম্য রমনীরা। পাশে তখন হরেক জিনিষের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। শামুক ঝিনুকের অপূর্ব সমারোহ। বাতাসে ভেসে আসছে মাছ ভাজার গন্ধ। সব মিলে মিশে কখন যেন ভুলে যাবেন জীবনের যন্ত্রণা।

শঙ্করপুর সমুদ্র সৈকত

দীঘা আমাদের খুবই পরিচিত। আমার বন্ধু পলাশ বেড়াবার জন্য পরিচিতের চাইতে অপরিচিতের অধরাকে বেশী পছন্দ করে। কারণ তার সৌন্দর্য্য কুমারী কন্যার মতো। দীঘা ছেড়ে তাই আমাদের যাত্রা শুরু শঙ্করপুরে। দীঘা থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে এই সৈকত।

শঙ্করপুরকে একেবারে অধরা বা অচেনা বলা চলে না, তবু দীঘার মতো এত জনসমাগম সেখানে দেখা যায় না। এর মাধুর্য কুমারী কন্যার মতো না হলেও এখনও লোভনীয়। বার বার তা আপনাকে আকর্ষণ করবেই। দুপাশে ছোট ছোট জলাধার আর ইউক্যালিপটার এর জঙ্গল ছড়িয়ে। শঙ্করপুরে হোটেলগুলো একেবারে সমুদ্রের সন্নিকটে। তার জানলা বা ব্যালকনী থেকে সমুদ্র একেবারে প্রত্যক্ষগোচরে। এখানে সমুদ্র প্রেমবিহ্বল। তবে একদমই নির্জনে আপনি যখন গিয়ে দাঁড়াবেন তার কিনারে ঢেউগুলো ছুটে ছুটে আসবে আপনাকে ছুঁয়ে দেবে। ধুয়ে দেবে আপনার পা-। ধূয়ে দেবে সারা বছরের জমে থাকা মলিনতা। দীঘার তুলনায় এখানকার সমুদ্র খরস্রোতা। ঢেউগুলো বেশী বৃহৎ। তীরে এসে দাঁড়ালে সে আপনাকে ছুঁয়ে দিয়ে চলে যাবে গন্তব্যে – আবার গন্তব্য থেকে ফিরে আসবে আপনাকে ছুঁতে। সারা দিন ধরে চলবে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা।

এরই মধ্যে ভেসে আসবে ঝিনুক শামুকের সমারোহ। একটা একটা করে কুড়িয়ে নিলে দেখতে পাবেন অদ্ভুত অথচ অপূর্ব তাদের গঠন। এক একটা এক এক ধরণের। সৃষ্টিকর্তা এরূপেই তৈরি করেছেন তাদের। তবে যতই আকৃতিতে ভিন্ন হোক একটি সুতোয় গেঁথে ফেললে তারা অনায়াসেই সৌন্দর্য্যমন্ডিত করবে আপনার গলা। এখানকার হোটেল গুলোতে ন্যুনতম ১০০ টাকায় খাবার পাওয়া যাবে। ভাড়াও রেঞ্জের মধ্যে। রান্না সহজপাচ্য। তবে দীঘার মতো এখানে পাবেন না দোকানীদের পসরা। শঙ্খ বা ঝিনুকমালার সমারো্হ। কেবল অনাবিল নিস্তব্ধতা আর নিবিড় নির্জনতা।

মোহময়ী মন্দারমণি

সমুদ্রের আরও এক মোহময়ী রূপ পাবেন মন্দারমণিতে। দীঘা থেকে খুব দূরে নয়। কেয়া কাঁটার জঙ্গল উচ্ছেদ করেই আবিষ্কার করা হয়েছে এর কিরণময়ী রূপকে। এর বিস্তীর্ণ তটে পড়ন্ত বিকেলে আপনি যদি হাঁটতে থাকেন দেখতে পাবেন রক্ত প্রবালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। অন্যদিকে অনতিদূরে রোজভ্যালির তৈরি ইমারৎ। একটা পুরো দিন না হলেও বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় সেখানকার খোলা হাওয়া আর ডাবের জলকে ভরসা করে। সেখানকার সমুদ্রে স্নান করে না তেমন কেউ। চারিদিকে বোল্ডার। তবে এখানকার সমুদ্রের বন্ধনহীন রূপ ক্ষণিকের জন্য হলেও মনের মধ্যে এনে দেয় মুক্তির স্বাদ। মানুষ সামাজিক জীব। বিভিন্ন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ সে। শূধু সম্পর্ক কেন? কখনও সামাজিকতা, কখনও কর্ম, বিভিন্ন বন্ধনে বন্দী হলেও সমুদ্রের এই তীরে দাঁড়িয়ে অনায়াসেই বলতে পারবেন –

“অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 − 2 =