পিছুটানে (চতুর্থ পর্ব)
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
দুর্গাপুর থেকে কলকাতা হয়ে মুম্বাই শচীন তেন্ডুলকরের বাড়ি। দুই হাজার কিলোমিটারেররও বেশি পথ ব্যাকগিয়ারে সড়ক পথে। পথে নানা ধরনের ভয়, বাধা, বিপত্তি। তবুও ছয় যুবকের এক নাছোড় লড়াই। পাঁচ দিনের যাত্রা পথে ভাল মন্দ মিশিয়ে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন এই অভিযানের সদস্যরা। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু হল নতুন ধারাবাহিক পিছুটানে। এ বারে চতুর্থ পর্ব।
প্রাতরাশ সেরে রায়পুর থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আগেই সঙ্গে থাকা ম্যাপে দেখে নিয়েছিলাম আমাদের বিশ্রাম বা মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি হবে নাগপুর। সেই মত ছুটল গাড়ি। এবারে রাস্তা অনেকটাই ভাল। ফোর লেনের মসৃণ রাস্তা, গাড়িও ছুটেছে হু হু করে। শহর ছাড়াতেই বদলে গেল দৃশ্যপট। চারপাশে মাঠ, তবে আমাদের বাংলার মত এতটা সবুজ নয়। খানিকটা ধুসরতা যেন কেউ মাখিয়ে রেখেছে সবুজের গায়ে। ইতিমধ্যে আমাদের উল্টোমুখে গাড়ির ছুট দেখে পথচলতি অনেকেই কৌতূহলী। কেউ কেউ দেখলাম আমাদের এই পিছুটানে গাড়ি চলা দেখতে আমাদের পিছু পিছু চলেছেন।
তাদের ইশারাতেই দাঁড়ানো হল মাঝে মধ্যে। সকলের সঙ্গে কথা বলে ফের দৌড় আমাদের। কমলা লেবুর শহর নাগপুরের কাছে এলাম যখন তখন প্রায় ১২টা বেজে গিয়েছে। শহরের কাছাকাছি এসে আমরা ঠিক করলাম শহরের ভিড়ে না গিয়ে বাইপাস হয়ে চলে যাব। সেই মত বাইপাস রোড ধরবার খানিক সময়ের মধ্যেই একটি গাড়ি এসে আমাদের পথ আটকাল। গাড়ি থেকে দুই তরুণ তরুণী বেরিয়ে এলেন। আমরা কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাচ্ছি? কি ব্যাপার বৃত্তান্ত সব শুনলেন। এর আগেও এমন অনেকেই শুনেছেন, তাই চটপট তাদের উত্তর দিয়ে আমরা চলে যাওয়ার তাল করছি। এমন সময় তারা জানালেন তারা মারুতি গাড়ি কোম্পানির দুই আধিকারিক। আমরা তাদের গাড়ি ভার্সা নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছি। ব্যাপারটা খুবই রোমাঞ্চকর এবং কঠিন বলে তাদের মনে হয়েছে তাই তারা অতিশয় আপ্লুত। পাশাপাশি তাদের আতিথেয়তায় যদি আমরা মধ্যাহ্নভোজন সারি তারা খুবই সম্মানিত হবেন। আমাদের দলের সকলেরই দেখলাম তাতে সম্মতি আছে। ব্যস হ্যা বলতেই তারা আমাদের প্রায় হাইজ্যাক করে নিয়ে চলে গেলেন শহরের একটি নামী রেস্তোরাঁয়। সে এক এলাহি আয়োজন, ভরপেট খেয়ে লস্যির গেলাসে যখন তৃপ্তির চুমুক দিচ্ছি তখনই সামনে বেশ কিছু কৌতুহলী মুখ।
এতদিন সাংবাদিকতায় আছি, মুখগুলি দেখেই বুঝে গেলাম তারা সকলেই আমার সতীর্থ। জিজ্ঞাসু হয়ে মারুতি কর্ত্রীর দিকে তাকাতেই জানালেন মারুতি থেকেই খবর দেওয়া হয়েছে সংবাদ মাধ্যমকে। তারা আমাদের এই অভিযানের খবর কভার করতে এসেছে। জাতীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে স্থানীয়, কেউ বাদ নেই। শুরু হল খাওয়ার পরে ইন্টারভিউ দেওয়ার পালা। আমি সব ক্ষেত্রেই সুনীতকে এগিয়ে দিয়ে পিছনেই রইলাম। এমনিতেও এই অভিযানের কৃতিত্ব সুনীতেরই পাওয়া উচিৎ। আমি বা আমরা তো সঙ্গী মাত্র। তবুও খবরের খুঁটিনাটি জানানোর জন্য শেষমেশ আমাকেও মাঠে নামতে হল। সকলের সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে, শুটিং সেরে আমরা যখন মুক্ত হলাম তখন প্রায় তিনটে বাজে।
অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি এগনোর পালা। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফের পথে আমরা। সামনে বড় শহর নাসিক। কিন্তু সে অনেক দূর। যাই হোক এগোন হল। যতটা এগিয়ে যাওয়া যায় আর কি। আশপাশে কমলালেবুর ক্ষেত, মাঝে কালো পিচ ঢালা পথ। কমলালেবুর সময় এটা নয়, তাই এখন এই বাগানের তেমন সৌন্দর্য মনে দাগ কাটে না। অনেকক্ষণ চলার পর সন্ধে সাতটা নাগাদ দাঁড়ানো হল একটি ধাবায়। কাছেই অমরাবতী শহর। ধাবায় আমাদের কথাবার্তা শুনে বা দেখে কৌতূহলী অনেকেই। একজন সৌম্যদর্শন মানুষ নিজে থেকেই আলাপ করতে এগিয়ে এলেন। আমাদের সব কথা শুনে বেশ উৎসাহিত মনে হল তাকে। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, রাতে আমরা থাকব কোথায়? সত্যি কথা বলতে কি এই প্রশ্নের উত্তর তখন আমাদের কাছেও ছিল না। বললাম নাসিকে থাকার চেষ্টা করব। শুনে বললেন নাসিকে পৌঁছতে রাত প্রায় দেড়টা দুটো হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং আজ রাতটা ওনার আতিথ্যেই কাটিয়ে দিই আমরা। চেনা নেই জানা নেই, এমন প্রস্তাবে আমরা তো হতবাক। আমাদের অবাক মুখ দেখে উনিই আস্বস্ত করলেন, ওনার বাড়িতে এত লোকের জায়গা হবে না, কাছেই একটা গেস্ট হাউজে উনি ব্যবস্থা করে দেবেন, সে জন্য কোনও পয়সাও লাগবে না। দলের সকলেই দেখি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। অর্থাৎ ম্যানেজার যা বলবে… আমি একটু ভেবেচিন্তে রাজিই হয়ে গেলাম। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলাটা উচিৎ হবে না। ওই ধাবা থেকেই রাতের খাবার নিয়ে নেওয়া হল।
উনি যেখানে নিয়ে গেলেন সেটি গেস্ট হাউজ নয়, স্থানীয় পূর্ত দফতরের একটি বাংলো। তার এক কথায় দরজা খুলে দিল কেয়ার টেকার। বিশাল বিশাল ঘর। আগেকার আমলের স্থাপত্য। দারুণ বিলাসবহুল ব্যবস্থা। এতটা আমাদের কেউই বোধ হয় আশা করেননি। সকলেই খুব আপ্লুত। ইতিমধ্যেই আলাপ হয়েছে তার সঙ্গে স্থানীয় জমিদার বংশের ছেলে তিনি। নিজেও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি। পরপোকারী যে, সে তো আমরা নিজেরাই দেখতে পেলাম। অনেক ধন্যবাদ জানানো হল তাকে, বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে বিদায় নিলেন তিনি।
সকলেই খুব ক্লান্ত, খাওয়া দাওয়া সেরে এবার আমাদের শুয়ে পড়বার পালা। নরম গদিতে দেহ পড়তেই বুজে এল চোখ। ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে ভোর বেলা। বাইরে বেরিয়ে দেখি নতুন প্রভাতের সূচনা। দিনের আলোয় দেখতে পেলাম যতটা আন্দাজ করছিলাম তার চেয়েও বড় এই বাংলোটি। সামনেও অনেকটা জায়গা। তবে আমাদের খুব বেশি শোভা দেখার জো নেই। কারণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে মুম্বাই। তাই চটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। গত রাতের সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে অবশ্য আজ আর দেখা হল না। তিনি ফোনেই আমাদের বিদায় দিলেন, বললেন ফেরবার পথে আবার দেখা করে যেতে। আমাদের গাড়ি আবার পথে…
(ক্রমশ…)