পিছুটানে (দ্বিতীয় পর্ব)
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
দুর্গাপুর থেকে কলকাতা হয়ে মুম্বাই শচীন তেন্ডুলকরের বাড়ি। দুই হাজার কিলোমিটারেররও বেশি পথ ব্যাকগিয়ারে সড়ক পথে। পথে নানা ধরনের ভয়, বাধা, বিপত্তি। তবুও ছয় যুবকের এক নাছোড় লড়াই। পাঁচ দিনের যাত্রা পথে ভাল মন্দ মিশিয়ে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন এই অভিযানের সদস্যরা। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু হল নতুন ধারাবাহিক পিছুটানে। এ বারে দ্বিতীয় পর্ব।
বাংলার সীমানা ছাড়াতেই দিনের আলো নিভু নিভু। এবার আমরা ঝাড়খণ্ডে। হ্যা, বাংলা ওড়িশার মাঝে এক চিলতে ঝাড়খণ্ড এখানে ঢুকে পড়েছে বলা যায়। নির্জন নিস্তব্ধ অরন্যময় পথ, আমরা এগিয়ে চলেছি দুরু দুরু বক্ষে। মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর মোটামুটি জনবহুল একটি জায়গা দেখে চা খাওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড় করানো হল। স্থানীয়দের কাছে থেকেই শুনলাম জায়গাটি ঝাড়খণ্ডের বহরাগোড়া। ব্যাকগিয়ারে গাড়ি চলছে দেখে অনেকেই কৌতুহলী, তাদের জানানো হল আমরা কি কাজে কোথায় চলেছি। এরই মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করলেন রাতে কোথায় থাকব। জানি না বলতেই তারা অবাক। কয়েকজন তো বলেই দিলেন সন্ধের পর আর এগোনই উচিৎ নয়। গোটা এলাকাই মাও উপত্যকা। এখানে এ সময়ে মানুষ বের হয় না। সবে সন্ধে ছটা, এখনই থেকে গেলে তো মুশকিল। ঠিক সময়ে মুম্বাই পৌঁছনোই যাবে না এবং কাছাকাছি কোনও থাকার ভাল জায়গাও নেই। অগত্যা রাম নাম জপতে জপতে রওনা হলাম সকলে। রাস্তা মোটেই ভাল নয়, অন্ধকারে দেখা মুশকিল। সুনীতের গাড়ির পিছন দিকে দুটি হেডলাইট লাগানো হয়েছে বটে কিন্তু তার জোর বড়ই কম। ওর পক্ষে গাড়ি চালানো বেশ মুশকিল। ঘন্টা খানেক যাওয়ার পর এল নতুন বিপদ। নামল মুশলধারে বৃষ্টি। এবার তো আমরা বেশ চাপে। সব চেয়ে অসুবিধায় সুনীত। চার পাশ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, তার উপরে বৃষ্টিতে দৃশ্যমানতা প্রায় নেই বললেই চলে, আমাদের সামনে মুখ করে গাড়ি চালাতেই রীতিমত অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে কি করে যে সুনীত ব্যাকগিয়ারে গাড়ি চালাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না। ওর শ্যালক বাবুকে ফোন করলাম, কি করা যায় ভেবে। বাবু বলল “জামাইবাবু বলছে সামনে এগিয়ে যাই যতটা পারি”।
বলে কি? অসুবিধা হচ্ছে না? বাবুর উত্তর “হচ্ছে, ওয়াইপার নেই তো… তবে সামলে নিচ্ছে জামাইবাবু। তুমি দাদা এগিয়ে চল”। এগিয়ে চলেছি, আধ ঘন্টা পর বৃষ্টি একটু কমে এল, এর মধ্যেই একটু আলো দেখে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম বাংরিপোশি। এ নাম তো চেনা, বুদ্ধদেব গুহ্, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সকলেই তো এর প্রেমে পাগল। এখানে থাকার জায়গাও তো আছে শুনেছি। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, একজন দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করতে সে সাফ জানিয়ে দিল, থাকার জায়গা আছে বটে তবে মাওবাদীদের ভয়ে তা বন্ধ, দিন দুয়েক আগেই ঝামেলা হয়েছে তাই এখানে না থাকাই ভাল। সেই বলল আরও একটু এগিয়ে বিষয়ীতে গেলে একটা ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু ঘাট পেরোতে হবে। এবারে একটু সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম, এই অন্ধকারে ঘাট পার হওয়া, সে তো বেশ চাপের ব্যাপার। জলে পড়ে টড়ে গেলে তো সব্বোনাশ। কিন্তু ম্যাপ যা বলছে আর আমার যা ভৌগলিক সামান্য জ্ঞান তাতে তো এখানে কোনও সেতুহীন নদী থাকার কথা নয়! দোকানীকে সে কথা বলতেই সে হেসে জানাল এখানে পাহাড়কে ঘাট বলা হয়। সামনেই পাহাড় আছে সেটা পেরিয়ে যেতে হবে। শুনে ধড়ে একটু প্রাণ এল বটে, তবে পুরোটা নয়। কারন সুনীতের গাড়িতে ভাল আলো নেই, ওয়াইপার নেই, এই অন্ধকারে বৃষ্টিতে পাহাড়ে ওঠা মানে তো প্রায় আত্মহত্যা করার সামিল। সুনীতও একটু অস্বস্তিতে আছে বলে মনে হল। পাহাড়ে আগে ব্যাকগিয়ারে গাড়ি চালায়নি ও, তার উপরে এই পরিস্থিতিতেই প্রথম পরীক্ষা… সেকেন্ড দশেক কি যেন ভাবল সুনীত, তার পরেই ফের চাঙ্গা, “চল দাদা যা হয় হবে, বেরিয়ে পড়ি। তুমি চলে এস আমার গাড়িতে, আলোচনা করতে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হবে”। আমি চলে এলাম সুনীতের ভার্সাতে। শুরু হল পথ চলা, মিনিট পাঁচেক পরেই ধীরে ধীরে গাড়ি সমতল ছেড়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। অন্ধকারেও বেশ বুঝতে পারছি সুনীতের চোয়ালটা কঠিন হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে গাড়ি উপরে উঠছে, ওপাশ থেকে আসা গাড়িগুলি এমন দৃশ্য দেখে চমকিত, তা তাদের হঠাৎ হঠাৎ ব্রেক কষা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে…
প্রায় আধ ঘন্টা রুদ্ধশ্বাসে চলার পর নেমে এলাম নিচে, বিষয়ী যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে রাত সোয়া আটটা। জনমনিষ্যির দেখা নেই, শুনশান চারিদিক। পথের পাশে একটি গুমটিতে আলো দেখে ডাকাডাকি করতে ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এল দুজন। তাদের কাছেই জানলাম এখানেও থাকার তেমন ব্যবস্থা নেই, সামনেই জশিপুরে হোটেল মিলবে, সেটাও প্রায় এক ঘন্টা। অগত্যা ফের পথ চলা, অন্ধকার লেপ্টেই আছে আমাদের সঙ্গে, একটাই ভাল, বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সুনীতকে বললাম এভাবে খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই রাতের বেলা কিছুই চিনি না আমরা তার চেয়ে বরং থানায় চলে যাওয়া ভাল। সেখানেই পুলিশকে বলে কয়ে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। প্রস্তাবটা সুনীতেরও বেশ মনে ধরেছে মনে হল। রাত প্রায় সোয়া নটা জশিপুরে এসে অবশ্য আলোর দেখা পেলাম, দু একটি দোকানপাটও খোলা। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেই থানার দিকে এগোলাম আমরা। থানার সামনে গিয়ে বুঝলাম মাও হিংসা এবং আতঙ্ক এখানে কতটা ভয়াবহ। থানার চারিদিকে বিশাল উচু পাঁচিল, তার উপরে তার কাঁটা দিয়ে ঘেরা। মাঝে মধ্যেই বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করা। সেখান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উচিয়ে সতর্ক প্রহরায় জওয়ানরা। আমাদের গাড়িদুটি যাওয়া মাত্রই ঘিরে ধরল চার পাঁচ জন জওয়ান। কি ব্যাপার, কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি ইত্যাদি নানান প্রশ্ন। তাদের বিষয়টা কিছুটা বলতে থানায় ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। তবে বড়বাবু নেই। আধ ঘন্টা পরে এলেন বড়বাবু। তাকে গোটা বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে বেশ উত্তেজিত তিনি। ইটিভি ওড়িশাতেও ব্যপক জনপ্রিয়। আমি ইটিভির প্রাক্তনী শুনে আরও উৎফুল্ল। থানায় রাত কাটাতে চাই শুনে কি যেন ভাবলেন? তার পরে কাকে একটা ফোন করে বললেন আমার সঙ্গে আসুন। আমরা অবাক হয়ে তার সঙ্গেই বেরোলাম, বাইরে গিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠতে যাব, বারণ করলেন বড়বাবু। বললেন আপনাদের গাড়িতে কমলা বাতি লাগানো আছে, সরকারী গাড়ি ভেবে মাও হানা হতে পারে। গাড়িদুটি বরং থানায় থাকুক, সকালে নিয়ে নেবেন। তার নিজের গাড়ি এবং অন্য একটি জিপে আমাদের তুলে নিয়ে এলেন একটি ধাবায়। ধাবাটি বেশ ধোপদুরস্ত। তার উপরেই আছে একটি ডর্মেটরি, সেখানে থাকা যেতেই পারে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আমাদের বেশ পছন্দ হল, ঠিক হল খাবার খেয়ে আমরা ওখানেই রাত্রিবাস করব। বড়বাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের খাবার খাওয়ালেন। খানিক সময় আমাদের সঙ্গে গল্পগুজব করলেন, তার কাছেই শুনলাম গোটা এলাকা এখন মাও হিংসায় জর্জরিত, রেহাই পাচ্ছেন না পুলিশ কর্মীরাও। সারাদিন প্রচুর খাটাখাটনি, দুশ্চিন্তা গেছে সকলেরই ঘুম পেয়ে গিয়েছে। বড়বাবু এবার বিদায় নিলেন, বলে গেলেন রাতে কোনও ডাকাডাকি বা আওয়াজে যেন আমরা দরজা না খুলি। থানার নম্বর দিয়ে গেলেন, কোনও সমস্যা হলেই ফোন করতে। তার ব্যবহারটি বেশ ভাল লাগল আমাদের। সেই ভাল লাগার মাঝেই কেমন একটা অস্বস্তি রয়ে গেল, চারিদিকে এত আতঙ্ক, এত ভয় নিয়ে এখানকার মানুষজনেরা আছে কি ভাবে! সেই অস্বস্তি নিয়েই আমরা শুতে গেলাম সকলে, তারপর…
(ক্রমশ…)