পিছুটানে (পঞ্চম পর্ব)

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

দুর্গাপুর থেকে কলকাতা হয়ে মুম্বাই শচীন তেন্ডুলকরের বাড়ি। দুই হাজার কিলোমিটারেররও বেশি পথ ব্যাকগিয়ারে সড়ক পথে। পথে নানা ধরনের ভয়বাধাবিপত্তি। তবুও ছয় যুবকের এক নাছোড় লড়াই। পাঁচ দিনের যাত্রা পথে ভাল মন্দ মিশিয়ে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন এই অভিযানের সদস্যরাসেই সব টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা নিয়ে গাঁথা মালা, ধারাবাহিক পিছুটানেএ বারে পঞ্চম পর্ব।

অমরাবতীর সেই বাংলো থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি আবার পথে। এর আগেই দু’একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পথের মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে নিয়েছি। এখান থেকে আকোলা হয়ে ধুলে, সেখান থেকে নাসিক হয়ে মুম্বাই। প্রায় সাতশো কিলোমিটার এখনও বাকি। সিদ্ধান্ত হল যতটা যাওয়া যায় আমরা আজ চলে যাব খুব বেশি দাঁড়াব না। রাস্তা অবশ্য বেশ ভাল, অসুবিধে হচ্ছে না, প্রায় নব্বই একশো স্পিডেই পিছনদিকে গাড়ি চালাছে সুনীত। আকোলা পর্যন্ত বেশ নিরুপদ্রবেই এলাম আমরা।

এবার রাস্তাটা একটু খারাপ হল। আমরা চলেছি গতি কমিয়ে। ধুলের কাছাকাছি দুপুর প্রায় দুটো, একটা ছোট অথচ খরস্রোতা নদী পেরোলাম আমরা। তারই পাশে একটা ধাবা দেখে দাঁড়ানো হল। মধ্যাহ্ন ভোজনের অর্ডার দিয়েই আমরা সকলে নদীর ধারে। চমৎকার নিরিবিলি পরিবেশ। নদীটিও খুব সুন্দর। তখন তো এখনকার মত মোবাইল ছিল না, না হলে কয়েকশো ছবি তুলে ফেলতাম আমরা। তবুও আমাদের সঙ্গে থাকা সবেধন নীলমণি একটি ক্যামেরা দিয়েই সকলের দুঃখমোচন করা হল। নদীর যে সেতুটি পার হয়ে আমরা এপারে এসেছিলাম সেই সেতুর অনতিদূরে পুরনো একটি ভাঙা সেতু রয়েছে। ভাঙা সেতুটি যেন জায়গাটির সৌন্দর্য আরও একটু বাড়িয়ে দিয়েছে মনে হল।

ছবি তুলে, নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে এবার খাওয়ার পালা। সকলে মিলে খাটিয়ায় বসে সামনে তক্তায় থালা রেখে মেজাজে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। ধাবায় আগেও খেয়েছি, তবে খাটিয়ায় বসে এভাবে এর আগে কখনও খাওয়া হয়নি। ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম লাগল। খেয়েদেয়ে আর বসার সময় নেই দ্রুত ছুটতে হবে। আমরা যেটাকে বম্বে রোড হিসেবে দেখি বা চিনি সেই রাস্তাটি কিন্তু ধুলেতে এসে অন্য একটি জাতীয় সড়কের সঙ্গে মেশে। ধুলে থেকে এবার বাঁ দিকে নাসিকের পথে আমরা।

রাস্তার ধারে পেঁয়াজের বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে কৃষকেরা। বুঝে গেলাম নাসিকের কাছাকাছি এসে গিয়েছি। নাসিকের পেঁয়াজের কথা সেই ছোটবেলা থেকেই শুনছি। আমাদের দাঁড়ানোর সময় নেই। যেতে যেতেই খোঁজ নিয়ে নিলাম পেঁয়াজ তিন থেকে পাঁচ টাকা কেজি। সুনীত বলল যাওয়ার সময় দু বস্তা তুলে নিয়ে যাব দাদা। এর আগের দিনই নাগপুর পেরিয়ে এসেছি কিন্তু মরসুম না হওয়ায় শুধু কমলা লেবুর বাগান দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এবারে নাসিক কিন্তু আমাদের নিরাশ করল না। না। পেঁয়াজের কথা বলছি না, নাসিকের আঙুরও কিন্তু বিখ্যাত। পেঁয়াজের পাশাপাশি বিঘের পর বিঘে আঙুরের ক্ষেতও ছড়িয়ে নাসিকের আশেপাশে।

রাস্তার ধারেই মিলে গেল তেমনই একটা আঙুরের ক্ষেত। পেঁয়াজ যেটা করতে পারেনি, সেটাই করে দেখাল আঙুর। আমাদের দুটি গাড়িই থেমে গেল আঙুরের টানে। গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে দেখি গাছ থেকে ঝুলছে থোকা থোকা আঙুর। সে দৃশ্য বলে বোঝানো যায় না। অমোঘ এক আকর্ষণে আমরা সকলেই ঢুকে গেলাম আঙুরের ক্ষেতে। ছবি তোলা হল আঙুরের সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। গাছ থেকে ছিঁড়ে টপাটপ শুরু হয়ে গেল আঙুর সেবন। আনন্দে কে যে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সুনীতও দেখলাম তার অভিযানের কথা ভুলে আঙুরে মত্ত। বুঝলাম আঙুর এভাবেই নেশা ধরায়। সেই নেশার ঘোরেই ছিলাম সকলে। হঠাৎ কার যেন চিৎকারে সম্বিৎ ফিরল আমাদের।

ঘোর ভাঙতেই দেখি আঙুর ক্ষেতের মালিক লাঠি নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে। কিছু বোঝার আগেই সে লোক আমাদের সামনে। দেখেই বুঝলাম সে বেশ রেগে গিয়েছে। সকলে আমাকে এগিয়ে দিল, আমি তো আমার অসাধারণ হিন্দিতে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছি যে ব্যাপারটা কি হয়েছে। সুনীতও বোঝাতে চাইছে শচীনের বাড়িতে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে কিছুতেই মানবে না। আরও এক দুজন চলে এল, সে এক বিপত্তি। অনেক কষ্টে, আমরা কলকাতা থেকে আসতা হ্যায়, আঙুর দেখ কর সামলাতে না পেরেই এই কাণ্ড ঘটায়া হ্যায় বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিস্তার পেলাম।

শুনলাম এমন ভাবে ক্ষেত থেকে তুলে আঙুর খেতে নেই, তুলে সংরক্ষণের পরেই নাকি তা খাওয়া উচিৎ। তা আমরা তো অপরাধ করেইছি, তাই ওদের কথা শুনে চুপচাপ গাড়িতে ফিরে এলাম। এসে দেখলাম আমাদের সঙ্গে থাকা দু তিন জন আগেই গাড়িতে চলে এসে বসে আছে। সকলেরই মুখ চুন, আগের খুশিটা তেমন নেই বকুনি খেয়ে। শুরু হল ফের গাড়ি চলা, মিনিট দুয়েক পরেই দেখি পিছন থেকে একটা অট্টহাসির আওয়াজ। হঠাৎ কি হল? কারন বুঝতে পিছনে তাকিয়ে হতবাক আমিও। সকলের হাতেই থোকা থোকা আঙুর। আমরা যখন মালিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম, বা বকুনি খাচ্ছিলাম তখন অন্যরা পিছন থেকে প্রায় কেজি পাঁচেক আঙুর ছিঁড়ে জামায় ভরে নিয়ে এসেছে। এবার বুঝলাম ওরা আগে থেকেই কেন গাড়িতে এসে বসেছিল।  আমার ভাগেও জুটে গেল আর এক থোকা আঙুর। উফ সে দৃশ্য এবং স্বাদ জীবনেও ভুলব না আমি।   

এবার ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল দৃশ্যপট। এতক্ষণ প্রচুর ক্ষেত, মাঠ এসব পেয়েছি। এবার শুরু হল রুক্ষ পাহাড়। তার সৌন্দর্য আবার অন্য ধরণের। নানান গড়নের, নানান আকৃতির সেই সব পাহাড়ের গা বেয়ে এগোতে লাগল আমাদের গাড়ি…  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 − three =

preload imagepreload image