পুজোর গান
রাজর্ষি বর্ধন, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##
[ ১ ]
তারা সবাই ছুটতে আরম্ভ করে দিয়েছে, খালি পায়ে মাঠের ওপর দিয়ে! তাদের জামা-কাপড়ে লাগছে চোরকাঁটা, ছোট-ছোট পায়ে লাগছে কাঁদা – তবু তাদের সেদিকে হুশ নেই! তারা সবাই ছুটতে ব্যস্ত, বেশি দেরী হলে তো সুজন মিত্রকে তো আর দেখাই যাবে না!
তাদের পাশের গ্রাম পলাশডাঙ্গায় প্রত্যেকবছরই পঞ্চমীর দিন পুজো উদ্বোধন করতে অনেক বড়-বড় শিল্পীরা আসেন। এবারে যেমন এসছেন সুজন মিত্র – বাংলার এক নম্বর গায়ক! তার সিনেমার গান লোকের মুখে-মুখে ঘোরে! উদ্বোধনেও গাইবেন, তাই পাশের সব গ্রাম থেকে ছাপিয়ে লোক আসছে!
যারা ছুটছে তারা সংখ্যায় সাত, বয়স তাদের দশ-এগারোর আশেপাশে। তাদের মধ্যে যে সব থেকে জোরে ছুটছে, তার নাম বিজয়, ডাক নাম বিজু। তাদের বস্তিতে তাকে সবাই ‘গায়ক বিজু’ বলে ডাকে! এইটুকু বয়সেই কি গানের গলা! তালিম ছাড়াই এমন, তালিম নিলে আর দেখতে হবে না – সবার এরকম মত! কিন্তু বিজুর বাবা কারখানার শ্রমিক, মা লোকের বাড়ি আয়া! ঠিকমত খাওয়াই জোটে না, গান শেখা তো তাদের কাছে বিলাসিতারও অধিক!
মঞ্চের সামনে উপচে পড়া ভিড় দেখে বোঝা গেলো যে সুজন মিত্র এসে পড়েছেন! একটু পড়েই তার গান আরম্ভ হবে, চারিদিকে কূল ধরানোর জায়গা নেই, এতো লোক! তারা সবাই মঞ্চের পেছন দিকে গেলো, যদি সেদিক থেকে পৌঁছান যায়!
কিন্তু সেখানে একজন মোটা মতো লোক তাদের আটকালও! সে এই ক্লাবেরই একজন। কি বিশাল চেহারা! বাঁ গালে কাঁটা দাগ থাকায় আরও ভয়াবহ লাগছে! গম্ভীর গলায় বলল, “কি চাই?”
বিজু এগিয়ে এসে বলল, “একবার সুজন মিত্রের সাথে”…
“হবে না – চল এখান থেকে!”
বিজু ব্যাকুল হয়ে বলল, “একবার দেখা করেই চলে যাবো! আমিও গান গাই!”
এবার কোন কথা না, সপাটে একট চড়! বিজু পড়ে যায়! গালকাঁটা লোকটা বলে, “গান গাস বলে কি মাথা কিনে নিয়েছিস! ফের যদি এখানে দেখি তো সব কটাকে পুলিশে দেবো! হা-ঘরের দল যতসব!”
বিজুর গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ে। চারিদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় – সুজনকুমার মঞ্চে উঠেছেন……
[২]
পলাশডাঙ্গার পুজো এবার পঁচাত্তর বছরে পড়েছে, তাই তাদের আয়োজনও বিশাল! এবার তাদের দুজন অতিথি আসছে- টালিগঞ্জের এক নম্বর নায়ক কুমারজিৎ আর গায়ক বিজয়কুমার, যাকে দেশের লোক একডাকে চেনে! এমনও সোনা যাচ্ছে, কুমারজিৎ থাকা সত্ত্বেও সব আলো নিয়ে যাবেন বিজয়কুমার!
মঞ্চ প্রস্তুত, বিজয়কুমার খানিকক্ষণ পড়েই মঞ্চে উঠবেন। লোকেদের ভিড়ে ব্যারিকেড ভেঙ্গে পড়ার জোগাড়! মঞ্চে ওঠার আগে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট গদগদ হয়ে বিজয়কুমারের সামনে আসলেন – তিনিও আজ দারুন সেজেছেন! হাতে সোনার চেন, গায়ে গিলে-করা পাঞ্জাবী! শুধু বাঁ গালের কাঁটা দাগটাই বেমানান লাগছে!
এককথা -দুকথার পর বিজয়কুমার বললেন, “আমার একটা অনুরোধ রাখতে পারবেন ?”
গদগদ ভাবটা বাড়িয়ে প্রেসিডেন্ট বললেন, “নিশ্চয়ই! এ তো আমার সৌভাগ্য!”
বিজয়কুমার বললেন, “আমার বাচ্চাদের জন্য যে গানটা গাইব, সে সময় এখানকার বস্তির যত ছেলেমেয়ে আছে, তারা যেন মঞ্চের ওপরে থাকে! এটাই আমার অনুরোধ!”
প্রেসিডেন্ট যেন আকাশ থেকে পড়লেন! থতমত খেয়ে বললেন,”কি বলছেন স্যর, ওরা স্টেজে উঠবে!”
হাল্কা হেসে বিজয়কুমার বললেন, “প্রত্যেকবারই ওরা এসে গলাধাক্কা খাবে, এমনটাও কি হতে দেওয়া যায়!”
প্রেসিডেন্ট বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন, এদিকে দর্শকের সমবেত চিৎকার আকাশ ছাপিয়ে যেতে লাগল……
এই সংখ্যা সুন্দর ভাবনার ফসল।
সম্পাদকের ও মুন্সীয়ানার তারিফ না করে পারলাম না।
হার্দিক শুভেচ্ছা।