বন – জোছনা

চিত্রা দাশগুপ্ত  ##

সমীরণ স্মার্ট ফোনটা লকডাউনের কিছু দিন আগে কিনেছে। প্রথমে টাচস্ক্রিনটার জন্য একটু ঝামেলা হচ্ছিল, তাছাড়া এত রকম ফিচার এতরকম আ্যাপ, সরগড় হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে সমীরণের।  

তবে এখন সব নখদর্পণে,এক আঙ্গুলের ছোঁয়াতে বিল পেমেন্ট, অন লাইন কেনা-কাটা, ক্যাব ডাকা, মায় নিজের লেখা গল্প কবিতা পটাপট়্ গ্রুপে পোষ্ট করে ফেলছে ।

সবে কাজ থেকে রিটায়ার করেছে। দশ বছর হল বিপত্নীক। দুটি ছেলে, একটি ইউ-এস-এ এবং একটি দুবাই, নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সমীরণ তিন কামরার এক ফ্ল্যাটে থাকে, ব্যালকনিতে সখের ছোট বাগান। স্ত্রী মালার আমলের কাজের মাসী রান্না-বান্না ও ঘরের কাজ করে দিয়ে যায় রোজ। মর্নিং ওয়াকের একদল বন্ধু নিয়ে আর লেখালিখি করে সময় কাটায় তবে ইদানীং বাড়ি বসে-বসে আর রিটায়ার্ড হওয়াতে খুব মনমরা লাগে ,বড় একা লাগে সমীরনের। 

ক্রিয়েটিভ রাইটিং আর অন্যরা নতুন কি পোস্ট করল বলতে গেলে এই সব নিয়ে ডুবে থাকে সারাটা দিন। বেশ কিছু দিন থেকে দেখছে বন-জোছনা নামে আর প্রোফাইলে একফালি চাঁদনি-রাতের ছবি দিয়ে রোজ খুব সুন্দর সুন্দর লেখা পোষ্ট করছে কেউ। লেখা পড়ে সমীরণ ধরেই নেয় ইনি এক মহিলা ও সুলেখিকা । ওর যেন নেশা ধরে গেছে ঐ নামটায় ,নামটা দেখলেই একনিশ্বাসে পড়ে ফেলে কি লিখেছে , আর মন খুলে মন্তব্য জানিয়ে কমেন্ট পাঠায়। 

অপর দিক থেকে বন-জোছনা ধন্যবাদ সহকারে তার প্রাপ্তির স্বীকৃতি জানায়। 

বন-জোছনাও নিয়মিত ভাবে সমীরণের লেখা পড়ে মতামত জানায় এবং দুজনের মধ্যে সাহিত্যকে কেন্দ্র করে বেশ সুন্দর এক সখ্যতা গড়ে উঠেছে। 

সাত-পাঁচ ভেবে সমীরণ একদিন বন-জোছনাকে এক ফ্রেন্ড-রিকয়েস্ট পাঠাল। 

কেউ কাউকে জানে না – চেনে না, দেখেনি তবু ভালো বন্ধু হল ওরা,

আর খুব সুন্দর এক ভার্চুয়াল বন্ধনে জড়িয়ে পড়ল দুজনে। 

বন-জোছনা যেন সমীরণের মন বুঝতে পারে, ওর গল্প পড়ে অবাক হয়ে যায় সমীরণ ভাবে মুখফুটে যা ও বন-জোছনাকে বলতে পারেনি তা কি করে ও জানল? তবে কি ওর উচিৎ কিছু বলা ,লজ্জা না করে ও কি বন-জোছনার কাছে নিজের মনের-বাতায়ন খুলে দেবে ? জানতে চাইবে ও কোথায় থাকে, ওর নাম ধাম, ঠিকানা ওর পরিবার….একটা ছবি পোষ্ট করেতে বলবে ওকে?  প্রোফাইলে তেমন কিছু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। 

অপর দিকে বন-জোছনার সমীরণের গল্প ,কবিতা পড়লে কেমন যেন মনটা  

অবাধ্য হয়ে ওঠে ,স্বপ্নের দেশে হারিয়ে যায়, সব বাঁধা-বন্ধন ছিড়ে ছুটে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। কিন্তু চঞ্চল …

স্বামী চঞ্চলের অচল নিথর দেহটার দিকে তাকায় শর্বরী। বিয়ের ঠিক দুবছর পর এক বাইক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল-কর্ড ভেঙে শয্যাশায়ী আজ পঁচিশ বছর। নড়া-চড়ার ক্ষমতা নেই,কথা ও তেমন বলে না শুধু দুচোখ দিয়ে শর্বরীকে দেখে, অনুসরণ করে। 

চঞ্চল ওর সহ-পাঠী ছিল, তিনকুলে আর কেউ নেই ।

বিয়ের সময় মা-বাবার তাই প্রচন্ড আপত্তি ছিল। আজ শর্বরীর পাশে তারাও নেই। শর্বরী নিজেকে শাসন করে বলে সীমা ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে গেছ শর্বরী আর না, বন্ধ কর তোমার এই খেলা । তোমার তপস্যা এখনও শেষ হয়নি, তোমার মুক্তি নেই….

শর্বরী দেখেছে ও যদি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে তবে চঞ্চল কি করে বোঝে তা ও জানে না, কিন্তু কেমন যেন ভয়ে আরও গুটিয়ে যায় ,খাওয়া দাওয়া করে না, চোখে জল চিকচিক করে। আজ খেতে চাইছিল না, আয়া মাসি চোখ মোছাতে মোছাতে বলছিল কেঁদ না খেয়ে নাও।    

কাল সকালে অফিস যেতে হবে। আলো নিবিয়ে পাশের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ে শর্বরী । দু’চোখের জল গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে ……

আবার উঠে বসল শর্বরী হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে ল্যাপটপটা টেনে নিল ।সমীরণের প্রোফাইল পিকচারটা  আর একবার দেখে কাঁপা-হাতে ওকে আন-ফ্রেন্ড করে শর্বরী বন্ধ করে দিল ওর ল্যাপটপ। ফ্রেন্ড-লিস্ট থেকে নাম আন-ফ্রেন্ড করল  কিন্তু মন থেকে কি করে ডিলিট করবে ? সেটা তো শেখা হয়নি …… !

One thought on “বন – জোছনা

  • February 10, 2021 at 9:35 am
    Permalink

    আমার বন জোছনা গল্পটি মননিত হয়ে পত্রিকায় স্থান করে নিয়েছে দেখে আনন্দিত হলাম ।
    ধন্যবাদ জানাই।
    চিত্রা দাশগুপ্ত ‌

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − eight =