বাঙালির গান (পর্ব ৯)
পার্থসারথি সরকার ##
কলকাতার আদিপর্ব ও সংগীত চর্চা: বিষয় কবিগান
ইউরোপীয়দের বঙ্গদেশে পদার্পণ এবং কলকাতার উদ্ভব-সংক্রান্ত জনসাধারণের বিশ্বাসযোগ্যতা বাধাপ্রাপ্ত হ’তে পারে যদি কলকাতার আদি ইতিহাসকে ঠিকভাবে পর্যালোচনা করা যায়। শুধু কলকাতা নামমাত্র নয়, কলকাতা নামের জনপদের উল্লেখ বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্যে দুর্লভ নয়। মধ্যযুগের বেশ কিছু কাব্যে কলকাতা জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ ১৪৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত। এখানে কবি চাঁদ সওদাগরকে যে পথে বাণিজ্যে পাঠিয়েছিলেন, সেখানে গঙ্গার তীরে যে জনপদগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়, সেখানে আছে—কুমারহট্ট, ভাটপাড়া, কাঁকীনাড়া, মূলাজোড়, পাইকপাড়া, ভদ্রেশ্বর, চাঁপদানি, ইছাপুর, বাঁকিবাজার, মাহেশ এবং তারপরে—
“রিসিড়া ডাইনে বাহে বামে সুকচর।
পশ্চিমে হরিষে রাজা বাহে কোননগর।।
ডাহিনে কোতরং বাহে কামারহাটী বামে।
পূর্বেতে আঁড়িয়াদহ ঘুসুড়ি পশ্চিমে।।
চিতপুরে পুজে রাজা সর্বমঙ্গলা।
নিশি দিশি বাহে ডিঙ্গা নাহি করে হেলা।।
পূর্ব কূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা।
বেতড়ে চাঁপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।।
কালিঘাটে চাঁদ রাজা কালিকা পূজিয়া।
চূড়াঘাট বাহি যায় জয়ধ্বনি দিয়া।।”১
মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ বা ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যও তারই সাক্ষ্য বহন করে। ‘চন্ডীমঙ্গল’-এ পাওয়া যায়—
“ডাহিনে মাহেশ রাখি চলে খড়দহে।।
কোন্নগর কোতরঙ্গ এড়াইয়া যায়।
কুচিনাম ধনপতি দেখিবারে পায়।।
ত্বরায় বাহিছে তরী তিলেক না রয়।
চিত্রপুর শালিখা সে এড়াইয়া যায়।।
কলিকাতা এড়াইল বেণিয়ার বালা।
বেতড়েতে উঠিল অবসান বেলা।।
ডাহিনে ছাড়িয়া যায় হিজুলির পথ।
রাজহংস কিনিয়া লইল পারাবত।।
বালীঘাট এড়াইল বেণের নন্দন।
কালীঘাটে গিয়ে ডিঙ্গা দিল দরশন।।”২
আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’-তেও কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে, একথা ঠিক যে, সেদিনের জনপদ কলকাতার সঙ্গে আজকের নগর কলকাতার পার্থক্য বিস্তর। সেদিনের কলকাতার সঙ্গে অধুনা নগর কলকাতার যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তার অনেকখানিই ইউরোপীয়দের জন্য ঘটেছে সেকথার মান্যতা দিতেই হয়। বঙ্গদেশের সঙ্গে বাণিজ্যসূত্রে পরিচিত হয়েছিল যে জাতিগুলি, তাদের মধ্যে পর্তুগিজরা প্রধান। সম্ভবত ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে যখন দিল্লীর মসনদে হুমায়ূন, তখনই পর্তুগীজরা ভারত ও বঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে তোলে। এ সময় বঙ্গদেশে সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র বলতে দুটি। প্রথমটি হল পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম—যা লোকমুখে চাটগাঁ নামে পরিচিত, এবং অন্যটি হল পশ্চিমবঙ্গের সপ্তগ্রাম, যা সাতগাঁ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামের বাণিজ্য বাধাপ্রপ্ত হল সমকালীন সংকটময় পরিস্থিতির জন্য। পার্শ্ববর্তী আরাকানে তখন মগের রাজত্ব, তাদের অবাধ লুটপাট এবং ইউরোপীর জনগণের উৎপাতের জন্য চট্টগ্রাম ক্রমেই বাণিজ্যের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠতে লাগল। স্বভাবতই ব্যবসায়ীরা এই স্থান পরিত্যাগের পাশাপাশি নতুন বাণিজ্যকেন্দ্রের দিকে ক্রমেই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। পর্তুগীজরা যখন চাটগাঁ ছেড়ে সাতগাঁকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে পাকাপাকিভাবে বেছে নিলেন, তখন শেঠ ও বসাকরাও তাদের ব্যবসার তাগিদে সাতগাঁকেই ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র করে নিলেন। শেঠ ও বসাকরা ছিলেন তন্তুবায়-শ্রেণির মানুষ। তাঁরা পর্তুগীজদের কার্পাসজাত দ্রব্য এবং কার্পাস সরবরাহ করতেন। পর্তুগীজদের ব্যবসাকেন্দ্র বদল এবং সপ্তগ্রামকে বাছার কারণেই এঁদের পূর্ববঙ্গের পাঠ উঠিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এপারে আগমন হয় এবং এঁরা হুগলীর সাতগাঁয়ের কাছাকাছি হরিতিপুর গ্রামে বসবাস স্থাপন ক’রে বাণিজ্য চালাতে শুরু করেন। সরস্বতী ভাগীরথীর শাখানদী হিসাবে নির্গত হয়ে আবার ভাগীরথীতেই বিলীন হয়েছিল। ক্রমশই সরস্বতীতে চড়া পড়তে শুরু করে এবং সরস্বতী খালে পরিণত হয়। এর ফলে বেতড় বা বেঁটড়্যাতে পর্তুগীজরা তাদের কারবার তুলে আনে এবং সেই সঙ্গে শেঠ ও বসাকরাও সেখানে পূর্বের স্থান ত্যাগ ক’রে সরে আসেন এবং তাদের বাস এই বেতড়ের কাছাকাছি কলকাতাতে উঠিয়ে নিয়ে আসেন।
১৫৯৪ খৃস্টাব্দে বাংলার সুবেদার হয়ে আসেন আকবরের সেনাপতি মানসিংহ। তাঁর সুবাদেই বড়িশার সাবর্ণ-চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গাঙ্গুলী গঙ্গার পূবপাড়ে একটি বড় ভূখন্ড লাভ করেন। উত্তরে দক্ষিণেশ্বর থেকে শুরু করে দক্ষিণে বেহালা-বড়িশা, পূর্বে ধাপা থেকে শুরু করে পশ্চিমে ভাগীরথী পর্যন্ত এই ভূখন্ডের সীমা। এই ভূখন্ডের উত্তর দিকে শেঠ ও বসাকরা সাবর্ণ-রায়চৌধুরীদের কাছ থেকে একখন্ড জমি সংগ্রহ করেন। এই জমির একটি অংশ শেঠদের গৃহদেবতা গোবীন্দজীর নামানুসরণ হয় গোবিন্দপুর এবং অন্য অংশটি যেখানে প্রধানত সুতি বস্ত্রের জন্য সুতোর নুটি তৈরী হ’ত সেটি সুতানুটি নামে পরিচিত হয়, এবং এই দুই স্থানের মধ্যবর্তী অংশটি যেটি গঙ্গার চাঁদপাল ঘাট থেকে নিমতলা ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত সেটি কলকাতা গ্রামের মধ্যেই ছিল; তাই সেটি ‘কলকাতা’ নামেই পরিচিত হয়ে যায়। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে শাজাহান ভারত থেকে পর্তুগীজদের উন্মূল করার জন্য কাশিম খাঁ-কে বঙ্গে প্রেরণ করেন হুগলীর ফৌজদার হিসাবে। কাশিম খাঁ সেই কাজ পালন করলেন। পর্তুগীজরা চলে গেলে বঙ্গে ডেরা বাঁধল ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ইংরাজরা প্রথম কু্ঠি স্থাপন করে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে। ১৬৫০-এ জাহাঙ্গীরের ফরমান-বলে তারা মালদা, পাটনা ও ঢাকায়ও কুঠি বানিয়ে ফেলে। জোব চার্ণক কলকাতায় প্রথম আসেন ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয়বার ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট। অনেকে জোব চার্ণকের দ্বিতীয়বার কলকাতা আগমনকে কলকাতার জন্মতারিখ হিসাবে চিহ্নিত করতে চান, তবে সে মত গ্রহণযোগ্য নয়, বড়িশার সাবর্ণ-রায়চৌধুরীরা এই নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন এবং জোব চার্ণকের দাবী খারিজ হয়। সত্যিকারের গ্রাম কলকাতা থেকে নগর কলকাতার আসল সূচনা পর্বের জন্য আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়; যখন শোভা-সিংহের বিদ্রোহদমনে মুঘলদের সাহায্য করে আজিম-উস্-শানের কাছ থেকে ইংরেজরা কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটির জমিদারী-স্বত্ব কিনে নেন মাত্র ষোল হাজার টাকায়।
ইংরেজ-অধিকৃত এই তিনটি গ্রাম মিলিয়ে উৎপত্তি হয় নগর কলকাতার। কলকাতার এই গড়ে ওঠার প্রাক্ মুহূর্তেই সমকালীন বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তার গঠনকার্যে সাহায্য করল। মুসলমান-সুবেদারদের খামখেয়ালীপনা ও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বাংলার সর্ব প্রান্ত থেকেই জমিদার ও বিত্তবান গৃহস্থেরা তুলনামূলক নিরাপদ স্থান হিসাবে নতুন গ’ড়ে-ওঠা শহর কলকাতাতেই আশ্রয় লাভ করতে চাইল। আর এই কলকাতামুখী-মানসিকতার ফলে কলকাতার জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকল। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে কলকাতার এই ক্রমশ পরিণতিলাভে শ্রমিকের চাহিদা বাড়তে লাগল, যা মূলত রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য। পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল ছাড়াও বিহার ও ওড়িশা প্রদেশ থেকেও মানুষজন কলকাতায় আসতে শুরু করল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই রকম একটি মুহূর্তেই ১৭৪২-৪৫ খ্রিস্টাব্দে মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ ঘটল, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার পতনে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতাবোধে ভুগতে লাগল। ফলত কলকাতার জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করল। বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস এই সময় মুর্শিদাবাদ থেকে বিচার, শাসন ও রাজস্ববিভাগ কলকাতায় তুলে আনলেন। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হ’ল, এবং সেখানে মামলা সংক্রান্ত সব বিষয়ের সঙ্গে জড়িত মানুষেরাও কলকাতায় ভিড় বাড়াতে শুরু করলেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, যেখানে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার লোকসংখ্যা ছিল বারো হাজার, সেখানে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে তা সাত লাখেরও বেশী হয়ে গেল।
কলকাতার এ সময়ের ইতিহাস এক অদ্ভুত ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস। সদ্য গ’ড়ে ওঠা নগরীর মধ্যে মিশেল হয়েছিল নানা জাতের এবং নানা পেশার মানুষের। তারা যেমন পাচ্ছিল সচ্ছল জীবন, তেমনি পাচ্ছিল ইংরেজ শাসনের ফলে রাজধানী কলকাতায় নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তার কারণে অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষেরা যেমন একদিকে কলকাতায় পরম নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছিলেন, তেমনি সাধারণ মানুষও সাবলীলভাবে তাদের জীবন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এ-সময় মানুষজন নানারকম পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সদ্য গড়ে ওঠা নগর কলকাতার প্রয়োজনেই ঠাঁই নেওয়া এই নানা পেশার মানুষ যেমন এসেছিলেন বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, তেমনি তাঁরা অনেকেই একেবারেই সাধারণ শ্রেণির মানুষ। সুতরাং তাঁরা অবস-বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে যে গান বাছবেন তা সাধারণ মানুষের হবে, তা বলাই বাহুল্য। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের পূর্বের চিরাচর্চিত গান। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কিংবা কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম পেঁচার নক্সা’ অনুধাবন করলে তাঁদের গানের স্বরূপ চেনা যায়।
ঠিক এই সময়ে কর্ণওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ (Permanent Settlement) ফলে মুর্শিদকুলি খানের সমসাময়িক ভুস্বামীগণ বেকায়দায় পড়ে গেলেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধ প্রমাণ করে দিয়েছিল ইংরেজদের শক্তিকে। আর পরবর্তীতে তেমন কোন বিদ্রোহের সম্ভবনার কথা মাথায় রেখেই ইংরেজ সরকার মুর্শিদকুলি আমলের জমিদারদের পুরোপুরি বিনষ্ট করার জন্য সচেষ্ট হলেন। হেস্টিংস নিলামের মধ্যে দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ‘পাঁচশালা’ জমি প্রদানের ব্যবস্থা করলেন; আর এই ব্যবস্থা বাড়িয়ে কর্ণওয়ালিশ দশ বছরের জন্য ‘দশসালা’ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীতে ১৭৯৩-এর ১০ ফেব্রুয়ারি কর্ণওয়ালিশই একে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ (‘Permanent settlement’) রূপায়িত করলেন। আর এই সময়ে সে সমস্ত সম্পত্তি কিনে যারা ধনী হয়ে উঠলেন, সাধারণভাবে তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা কিংবা বুদ্ধিবিবেচনার বিশেষ বালাই ছিল না; এরা অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের বংশবদ; ফলত “এই সমস্ত মূঢ় মূর্খ অলস লম্পট অর্থগৃ ধ্নু অত্যাচারীরাই কলকাতা ও গ্রামবাংলার হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে বসলেন। এঁরাই হলেন আখড়াই-হাফ-আখড়াই-দাঁড়াকবি-যাত্রা-পাঁচালীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক।”৩
কালীপ্রসন্ন সিংহ এর বাস্তব বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য়—যেখানে নবো মুন্সি, ছিরে বেণে, পুঁটে তেলিরা রাজা হয়েছে এবং কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎ শেঠদের মতো বড় বড় ঘরের উৎসন্নে যাবার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে ভাগীরথীর দুই তীরের গ্রামীণ সংস্কৃতির রুগ্নদশা শুরু হ’ল। নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ থেকে জনজীবন ও সংস্কৃতি ভাগীরথীর স্রোতের সঙ্গে মিশে প্রবাহিত হ’ল সাগরসঙ্গমে। আর এই মিলিত প্রবাহ জন্ম দিল এক নতুন অধ্যায়ের, যা বিধৃত হয়ে থাকল বাঙালির মানসে, তার সংস্কৃতিতে।
এখানে ঘটল একদিকে ইংরাজদের হাতে গড়ে ওঠা নাগরিক সংস্কৃতি, আর একদিকে গ্রামীণ সংস্কৃতির মিশেল। একদিকে নতুনকে গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে প্রাপ্ত সম্পত্তির ভগ্নশেষ—বাংলার সংস্কৃতিকে এক গ্রহণ-বর্জনের খেলায় মাতিয়ে তুলেছে। ১৮৫৮ সালে বাংলা সাহিত্যে নাগরিক গান আবির্ভূত হ’লেও গত শতাব্দীর রেশ তখনও মিলিয়ে যায় নি তার বিশ-পঁচিশ বছর পরেও “কলকাতায়, গ্রামে গঞ্জে, লোকসমাবেশে সেই পূর্বতন জীবনধারার জের—বৈঠকীগান, কবিগান, ছড়া-পাঁচালী এবং তার সঙ্গে মঙ্গলগান, লীলা-কীর্তন, সঙ্কীর্তন, বাউলগান, মালসীগান (শাক্ত পদাবলী) প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হত।”৪
কবিগানের জন্ম কিন্তু শহরে নয়, গ্রামে—স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিগণের আনুকুল্যে। পরবর্তীতে কলকাতার বাবুসমাজে এর পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয়। কবিগানের উৎসানুসন্ধান করলে তার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কবিগানের জন্ম নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত। অনেকের মতে যাত্রা থেকে ঝুমুরের উৎপত্তি, তার থেকে কবিগান—ড: দীনেশচন্দ্র সেন এমনটা মত দিয়েছেন। তবে মোটামুটি বাংলা সাহিত্যের পণ্ডিতেরা সবদিক বিচার করে এর উৎপত্তি হিসাবে নির্ধারণ করেন ঝুমুর গান, যা ড. হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যরত্ন মনে করতেন। পাঁচালি থেকে কবিগানের উৎপত্তি এমন মতও প্রচলিত আছে। কবিগানের উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর মধ্যে। কবিগানের অংশবিশেষ খেউড় বা খেঁড়ু-র কথা আছে সেখানে—‘নদে শান্তিপুর হইতে খেঁড়ু আনাইব।/ নূতন নূতন ঠাটে খেঁড়ু শুনাইব।।’ এই বর্ণনা অনুসরণ করলে দেখা যায় যে ভারতচন্দ্রের সময়ে নবদ্বীপ, শান্তিপুরে দুর্গোৎসব উপলক্ষে খেঁড়ুগানের আসর বসতো এবং যার নতুন নতুন কায়দা-কানুন ছিল। রাজকুমার শিবচন্দ্রের লেখা ব’লে প্রাপ্ত ‘কি হলো ওলো ঠাকুরঝি’ খেউড়ের কথায় কবিগানের প্রাচীনত্ব এবং জনপ্রিয়তাকে মান্যতা দেওয়া যেতে পারে। খেউড়ের উৎপত্তি হিসাবে ন’দে শান্তিপুরের খেঁড়ু থেকেই খেউড়—যা কবিগানের আদিরূপ ব’লে অনেকে মনে করেন। তাঁদের মতে, গ্রাম্য নারীসমাজে প্রচলিত আদিরসের স্থূলরুচির গান থেকেই এর উৎপত্তি; তবে একথা অনুমেয় সমগ্র কবিগান নয়, কবিগানের উপসংহাররূপ খেউড়ই এখান থেকে এসেছে।
কবিগানে গ্রাম্য এবং নাগরিক এই অভিরুচির পদসঞ্চার। লোকগীতির অন্তর্ভুক্ত হলেও ভব্য সাহিত্যের সঙ্গে এর আত্মীয়তা আছে। এর বৈশিষ্ট্য একাধারে গীতাত্মক, অন্যদিকে কবিতাত্মক—এর মধ্যে দেবদেবীর লীলা, ভক্তির অনাবিল কথাও যেমন আছে, তেমনি আছে বাস্তব জীবনের রঙ্গরস, জীবনের মানবিক দিকগুলিও—যা কখনও কখনও গ্রাম্যতা ও ইতরতায় পূর্ণ। কবিগানের রচনাকার যেমন একাধারে নিরক্ষর বা স্বল্পাক্ষর গ্রাম্য অন্ত্যজ ব্যক্তি, আবার কখনও সুশিক্ষিত ভদ্রসম্প্রদায়। ফলত, কবিগান কখনও কখনও ভাঁড়ামি, আবার কখনও ভাব-ভাষায় নিপুণ দক্ষ ছন্দে গ্রথিত রচনা। প্রথমে গ্রাম্য সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত থাকায় কবিগান কীর্তন দ্বারা প্রভাবিত এবং পরবর্তীতে এই গানকে আখড়াই, হাফ-আখড়াইয়ের গড়ে ওঠাই অনেকখানি প্রভাবিত করেছে।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতানুযায়ী ঝুমুরকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়—(১) সখীসংবাদ (ব্রজলীলা), (২) আগম (ভবানী বিষয়ক), (৩) লহর (শ্লেষ ও ব্যঙ্গ), এবং (৪) খেউড় (অশ্লীল গান)। অন্যদিকে ব্রজসুন্দর সান্যাল মহাশয় কবিগানকে যে ভাবে বিন্যস্ত করেছেন, তা হল—(১) মালসী, (২) গৌরচন্দ্রী, (৩) সখীসংবাদ, (৪) গোষ্ঠ ও (৫) খেউড় বা কবি। জয়নারায়ণ ঘোষালের ‘করুণানিধানবিলাস’-এ ‘গুরুবন্দনা’, ‘সখীসংবাদ’, ‘বিরহ’ ও ‘খেউড়’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর সংগ্রহে রুচির মুখ রক্ষা করতে গিয়ে কবিগানের একটি বৃহৎ অংশ ‘খেউড়’ গানগুলিকেই বাদ দিয়েছেন—যা বাংলা সংগীত এবং সংগীতের ইতিহাসের বিবর্তন ও অনুধাবনের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি বলেই মনে করা যেতে পারে।
এ সময়ের যে সমস্ত লেখা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রায় সবেতেই এই গানের কখনও উল্লেখ, কখনও বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। তবে এ সবের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’। হুতোমের রচনার বহুস্থানেই এই কবিগানের উল্লেখ মেলে। সে সময় কবিগান আপামর ইতর ভদ্র সবাইয়ের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিল। এ কথার প্রামাণ্যতা এখানে মেলে—
“রাজা নবকৃষ্ণ কবির বড় পেট্রন ছিলেন। ইংলন্ডের কুইন এলিজেবেথের আমলে যেমন বড় বড় কবি গ্রন্থকর্ত্তা জন্মান, তেমনি তাঁর আমলেও সেইরকম রাম বসু, হরু, নিলু রামপ্রসাদ ঠাকুর ও জগা প্রভৃতি বড় বড় কবিওয়ালা জন্মায়। তিনিই কবি গাওনার মান বাড়ান, তাঁর অনুরোধে ও দেখাদেখিত অনেক বড় বড় মানুষ কবিতে মাত্লেন। বাগ্বাজারের পক্ষীর দল এই সময় জন্মগ্রহণ করে। শিবচন্দ্র ঠাকুর (পক্ষীর দলের সৃষ্টিকর্তা) নবকৃষ্ণের একজন ইয়ার ছিলেন। দু একটা আদ্মরা বুড়ো গোছের পক্ষী এখনও দেখা যায়, দল ভাঙা ও টাকায় খাঁক্তিতে মন মরা হয়ে পড়েচে সুতরাং সন্ধ্যার পর ঝুমুর শুনে থাকেন।”৫
পক্ষীর গানের প্রধান গায়ক ছিলেন বাগবাজার চিৎপুর অঞ্চলের রূপচাঁদ পক্ষী। জাতিতে ওড়িয়া। তিনি ওড়িশার কটক থেকে বঙ্গে এসেছিলেন। হুতোমের এই বর্ণনার মধ্যে কবিগানের প্রকৃত স্বরূপ এবং পর্যাক্রম খুব ভালোভাবেই লক্ষ করা যায়—
“ডেড় ঘন্টা ঢোল, বেহালা, ফুলুত,মোচাং ও সেতারের রঙ্গ ও সাজ বাজলো—গোঁড়ারা দুশ বাহবা ও বেশ দিলেন—শেষে একটা ঠাকরুণ বিষয় গেয়ে (আমরা গান্টি বুজ্তে অনেক চেষ্টা কল্লেম্, কিন্তু কোন মতে কৃতকার্য্য হতে পাল্লেম না) উঠে গ্যালে চকের দল আসরে নাবলেন।”৬
ভাবানী-বিষয়ক গানের পরে ‘গৌরচন্দ্রিকা’, আর তারপর ‘বিরহ’, যাকে ‘সখীসংবাদ’ বলে অনেকে মনে করেন। আবার কারো কারো মতে, ‘সখীসংবাদ’ ও ‘বিরহ’ মিলে ‘সখীসংবাদ’। প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থের মধ্যেও এই ‘সখীসংবাদ’-এর জনপ্রিয়তার রূপ দেখতে পাওয়া যায়। টেকচাঁদ ‘আলালে’ মতিলালের গলায় ‘নীলুঠাকুরের সখীসংবাদ’ বা ‘রাম বসুর বিরহ’ গাইতে দেখতে পাওয়া যায়। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-তে ‘বিরহ’-এর বিস্তৃত বর্ণনা আছে–
“ধোঁ দেখ্তে দেখ্তে পরিষ্কার হয়ে গ্যালো! দর্শকেরা সুস্থিত হয়ে দাঁড়ালেন, ধোপাপুকুরের দল আসোর নিয়ে বিরহ ধল্লেন। আদ ঘন্টার বিরহ গেয়ে আসোর হতে দল বল সমেত আবার উঠে গেলেন। চক বাজারেরা নাব্লেন ও ধোপাপুকুরের দলের বিরহের উতোর দিলেন—গোঁড়ারা রিভিউয়ের সোল্জারদের মত দল বেঁধে দু থাক হলো। মধ্যস্থ্ রা গানের চোতা হাতে করে বিবেচনা কত্তে আরম্ভ কল্লেন—এক দলে মিত্তির খুড়ো আর এক দলে দাদাঠাকুরের বাঁদন্দার!
বিরহের পর চাপা কাঁচা খেউড়; তাতেই হার জিতের বন্দোবস্ত, বিচার ও শেষ (মধুরেণ সমাপয়েৎ) মারামারীও বাকি থাক্বে না!”৭
আর এরপরে খেউড়। হুতোমের ‘নকশা’তে এই খেউড়ের একটি সুন্দর বাস্তব চিত্র আছে—
“তোপ্ পড়ে গিয়েচে, পূর্ব্বদিক্ ফরসা হয়েচে, ফুরফুরে হাওয়া উঠেছে—ধোপাপুকুরের দলেরা আসোর নিয়ে খেউড় ধল্লেন, গোঁড়াদের “সাবাস”! “বাহবা”! “শোভান্তরী”! “জিতা রও”! দিতে দিতে গলা চিরে গেলো; এরই তামাসা দেখ্তে যেন সূর্য্যদেব তাড়াতাড়ি উদয় হলেন! বাঙ্গালীরা আজো এমন কুৎসিত আমোদে মত্ত হন বলেই যেন—চাঁদ ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে লজ্জিত হলেন! কুমুদিনী মাতা হেঁট কল্লেন!
পাখীরা ছি! ছি! ছি! করে চেঁচিয়ে উঠ্লো। পদ্মিনী পাঁকের মধ্যে থেকে হাস্তে লাগ্লেন। ধোপাপুকুরের দল আসোর নিয়ে খেঁউড় গাইলেন সুতরাং চকের দলকে তার উতর দিতে হবে। ধোপাপুকুরওয়ালারা দেড় ঘন্টা প্রাণপণে চেঁচিয়ে খেঁউড়টি গেয়ে থাম্লে চকের দলেরা নাবলেন, সাজ বাজ্তে লাগলো, ওদিকে আকড়াঘরে খেঁউড়ের উতোর প্রস্তুত হচ্চে—চকের দলেরা তেজের সহিত উতোর গাইলেন!”৮
যদিও রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কবিসঙ্গীত’ প্রবন্ধে কবিগানকে ‘ক্ষণিকের ব্যাপার’ বলে মনে করেছেন এবং তাতে ভাবের গাঢ়তা ও পারিপাট্যের অভাব দেখেছেন, তথাপি বাংলা সংগীতের ধারায় এর মূল্য অনস্বীকার্য। কবিগান কোন ক্ষণিক বিষয় নয়। কবিগানের পর্ববিভাজন করতে গেলে ঈশ্বর গুপ্তকে সামনে রাখা যেতে পারে। কবিগানের প্রাচীনতার লেশটুকু মনে রেখেও বলা যায়, এই গানের পূর্ববর্তী ব্যপ্তিকাল খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ, অর্থাৎ গোঁজলা গুঁইয়ের জীবৎকাল থেকে শুরু ক’রে ভারতচন্দ্রের মৃত্যু পর্যন্ত (১৭৬০)। এই সময়কালের মধ্যে গোঁজলা গুঁইয়ের তিন চেলা—লালু-নন্দলাল, রঘুনাথ দাস ও রামজী দাস—‘এই তিনজন পুরাতন কবিওয়ালা’ বেঁচে ছিলেন। এই হল কবিগানের প্রথম পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায়টি এই পুরাতন কবিওয়ালাদের শিষ্য—রাসু-নৃসিংহ, হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, ভবানী বেণেদেরকে নিয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু ক’রে ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশক পর্যন্ত এর ধারা প্রবাহিত ছিল। এটাই হ’ল কবিগানের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ। এর পর হাফ-আখড়াইয়ের প্রচলন হয়, যদিও কবিগানের তৃতীয় পর্যায় চলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত। এই তৃতীয় পর্যায়েই কবিগানের চুড়ান্ত বিকাশ এবং অধঃপতনের সূচনা হয়। এরপর এই শতাব্দীর শেষ থেকে আধুনিক ভাবপ্রবাহে কবিগান ধীরে ধীরে শহর কলকাতা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়, যদিও এই গান গ্রাম বাংলার পরিবেশে আরো বহুদিন প্রচলিত ছিল। বিশ শতকের দ্বিতীর তৃতীয় দশকেও এর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল। এ সময়ে বিশিষ্ট কবিগায়ক ছিলেন গোমানী দেওয়ান ও লম্বোদর চক্রবর্তী। ‘বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে’ বিশ শতকের ষাটের দশকে এঁদের কবির লড়াই উপভোগ্য ছিল।
কবিগান কোন হঠাৎ সৃষ্টি নয়। শহর কলকাতা গড়ে ওঠার বহু আগে থেকেই এর অস্তিত্ব ছিল। এই গানের স্বাভাবিকতাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল রুচিশিক্ষাহীন নাগরিক বিলাসিতা। কবগানের যা অখ্যাতি তা জমা হয়েছে খেউড় ও লহর গানের অশ্লীলতা, অভব্যতা ও অশালীন গ্রাম্যতার জন্য। এ গানের মধ্যে অনেক ত্রুটি থাকলেও অনেক স্থানেই রচনাভঙ্গি, ভাবাবেগ ও আবেদনের নির্ভেজাল ঐকান্তিকতা উপলব্ধি করা যায়। কবিগানের প্রভাব বাংলা সংগীতের ইতিহাসে বহু বিস্তৃত। কবিগানের দ্বারা বহুক্ষেত্রে আখড়াই হাফ-আখড়াই প্রভাবিত হয়েছে। বাংলা সংগীতের ইতিহাসে তাই এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।