বিগ বাজার
মনালিশা শইকীয়া ##
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস ##
এভাবেই বিষণ্ণ দিনগুলির কামরা বহন করে নিয়ে যাওয়া রেলগাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। স্মৃতির ভারে দিনগুলিকে পরিপূর্ণ দেখাচ্ছিল। একদিন একটা কামরা থেকে নেমে এল শুক্রবারের বাজার। দীর্ঘ গতিপথে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে ওরা তাকিয়ে দেখে শুক্রবারের ছাইরঙা সন্ধ্যের দিকে। বিস্ফোরিত আলোর রেখার মতো ঝলসে উঠেছে পাথরের কুচির একটা রাস্তা, বিশাল শাখা প্রশাখার দ্বারা স্থিতি মজবুত করা একটা প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছের শিকড়ে কটারির দ্বারা কুপোতে থাকা ঐ যে বুধুয়া….। বাজারে আসা যাওয়া করতে থাকা মানুষগুলির সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো শ্লথ গতি। ভাগ্য ভালো গাছ কথা বলতে পারে না। নাহলে বুধুয়ার কটারির আঘাতে গাছও ককিয়ে উঠত!শুক্রবারের বিকেল মানেই উৎসাহ উদ্দীপনা। ঝুনঝুন পায়েল, ঝিন ঝিন কাঁচের চূড়ি, মুড়ির নাড়ু, শুকনো ভাজা এবং বাতাস কাঁপানো খিলখিল হাসির বন্যা।
এক আদিম মাতাল গন্ধ আগত রাতটাকে বন্য করে তোলার প্রয়াস করে। ঘর্মাক্ত শরীর, তামাক, বিড়ি এবং সুগন্ধি পাউডারের মিশ্রিত গন্ধ। বুধুয়ার মায়ের তপ্ত কড়াইয়ে শুকনো বুট ভাজা। গাছের পাতায় একটা পুঁটলি করে বেঁধে দেয়। দাম দশ পয়সা।
বুধুয়া কেরাসিনের প্রদীপটা তুলে ধরেছে। বসে থাকা বস্তাটা মেলে ধরে মা খুচরো পয়সা ভরাচ্ছে।
কড় কড়…। শুকনো বুট চিবুতে চিবুতে চলে যায় নৃ্ত্যরতা নিপুণ ভাস্কর্যেরা। কলী মেমের কাহিনি সম্পর্কে ওরা ওয়াকিবহাল।
ওরা জানে, কালো চামড়ার নাচে প্রবাহিত ওদের উত্তপ্ত রক্তে সাদা সাহেবদের ক্ষুধার পেয়ালা ভরে। কে জানে, সাহেবের দৃষ্টি কখন একটা যাঠির মতো কাকে ঘিরে ধরবে। সাহেবের গাড়ির আওয়াজ শুনলেই বুকে যেন মাদল বাজে। বাজারের পাশেই বাঁশ দিয়ে ঘেরা বেড়ার ওপাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে তার দুই চোখ। ঠিক রাতের তারার মতো।
ছোট্ট এতটুকু কলিজা। নতুন করে বাড়তে শুরু করা কফির চারার মতো সে ও বেড়ে চলেছে। ওপারের ব্যস্ত পৃথিবীটাকে স্পর্শ করতে না পেরে তার এই এতটুকু আত্মা ছটফট করতে থাকে। বাবু লাইন অতিক্রম করে লেবার লাইনে পা রাখতে পারে না। তার মস্তিষ্কে বিভেদের পাঠ। সেই বয়সে শ্রমিক কন্যা হতে না পারার যন্ত্রণায় সে দুঃখী ছিল। বাবু লাইনের পাকা ঘরের দেওয়াল ভালো লাগে না। সুশোভিত বাগান, বন্দি জীবন। বাঁশের বেড়ার ওপারের মুক্ত পৃথিবীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, খরগোশের মতো। সে তো খরগোশই। তাকালে তাকিয়েই থাকে। মিশ্রিত কোলাহল, চূড়ির ঝনঝনানি, বাঁদরের নাচ, ডম্বরুর আওয়াজ।
দুগ দুগ দুগ…
নাচ কদমী নাচ…
জনতাকে সেলাম দে।
দাঁড়িয়ে দে।
হাততালি…হাততালি। জনগণ হাতে তালি দিন।
অনেক মানুষের মিলিত হাসি। কেউ একটা ওলকবি ছুঁড়ে দিচ্ছে। একটা কুকিজ বিস্কুট। দোকানির সঙ্গে মেয়েরা হাসি ঠাট্টা করছে। ‘মাগ’ এতনা দাম। হামরা বস্তু নাই কিনব হ’….টুকন্টা কম কর দে। তবে হলে কিনে পারব’।
তেলে ভাজা ফুলরি, খুরমা, জিলিপির গন্ধ। কিনতে পারলে। দুহাত ভরিয়ে নানা ধরনের চূড়ি পরতে পারলে। পাতায় বাঁধা শুকনো দুটো বুট কটর কটর করে চিবোতে পারলে। কাঁপতে থাকা প্রদীপের আলোতে মুখগুলি যেন এক একটি ছবি। পরে সে কোথাও একটা টোকারি গীত শুনেছিল। বোধহয় কোনো মন্দিরের প্রাঙ্গণে। নতুবা অবনী দাদুর মুখে।
‘কেন এলাম মায়ার বাজারে
বাজারে বিকেল হয়ে এল
তেল নেই, সলতে নেই, প্রদীপ জ্বলেনি
অধমের কী গতি হল ।‘
জীবনের অর্থহীনতাকে চিৎকার করে জানাতে চাওয়া প্রাণকাতর সেই সুর কোথাও যেন বাজতে থাকে। সে কল্পনায় সৃষ্টি করেছিল একটা মায়ার বাজার দীর্ঘ সাদা জামা এবং খোলা চুলে মায়া বিকেলের বাজারে প্রবেশ করেছে…। সব কিছুই মায়াবী হয়ে উঠেছে। অসহায় পথিক পথের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক পরীর রূপকথার মতো একটা মায়ার বাজার!
কোথায় আছে সেই মায়ার বাজার! কে সেই পথিক? মায়ার বাজারে পা রেখে যে পথই হারিয়ে ফেলল! সে তো রঙ্গাগড়া বাজারটা দেখেছিল। দেখেছিল একদল মানুষের উন্মাদনা!
নিজদের মধ্যে স্ফুর্তি করে। চিৎকার-চেঁচামিচি করে। গান গায়। কাঁদে।
অনেক বছর পরে অর্থনীতির ছাত্রী হয়ে থাকার সময় সে বাজারের সংজ্ঞা পড়েছিল। একটা বিশাল বাজারের কথা। মূল্যের বিনিময়ে সামগ্রীর বিনিময় হওয়া বাজারের সঙ্গে কী এক তফাৎ ছিল সেই শুক্রবারের বাজারটার!
কলেজে ক্লাসের পরে সে তাকে বলেছিল শৈশবের সেই শুক্রবারের বাজারের কথা। এ পারে তাকিয়ে থাকা তার নিজের কথা। সে তার ক্ষীণ শরীরটা ঝেড়ে-ঝুরে একটা গতে এনে নেয়। তারপরে তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায় বলে যায়, তুমি বল তো, সেই বাজারে কী কী বিনিময় হয়েছিল? কেবল মূল্যের বিনিময়ে বস্তু? না, সেখানে আরও অনেক কিছু বিনিময় হয়েছিল। বিনিময় হয়েছিল হাসি। ভালোবাসা। তুমি হয়তো দেখতে পেলে না। সেখানে দুচোখের সলজ্জ চাহনির সঙ্গে বিনিময় হয়েছিল প্রেম। হৃদয়ের বার্তা …..‘বাঃ! বা! দোস্তি। অর্থনীতি ছেড়ে একেবারে ইংরেজি সাহিত্য ধরলে যে!’ ওরা সবাই মিলে হেসেছিল। সেও হেসেছিল, ঠোঁট দুটি সামান্য বাঁকা করে। তারপরে সিগারেটের ধোঁয়াগুলি কুণ্ডলি পাকিয়ে। তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ’সেই যে তোমার অবনী খুড়ো গেয়েছিল ‘মায়ার বাজারে কেন এলাম’ বলে… । সেই মায়ার বাজারে ইতিমধ্যে তুমি পা রেখেছ সোণপাহি……।’
আঃ কী যে এক আবেগে কখনো কীসব মেয়েটি গায় আর সে তাকে নাম দেয় ‘সোণপাহি’’ ফুলপাহি’…। বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, যেখানে সেখানে তাকে এই নামে ডাকতে থাকে। আর সত্যি সত্যিই সে এক শ্লথ গতিতে একটা মায়ার জগতে ঢুকে পড়ল। চারপাশে প্রহেলিকা। চমক। দলে দলে স্বপ্নের সওদাগরেরা আসতে শুরু করেছে। প্রত্যেকেই নিজের নিজের ব্যবসা খুলে বসেছে। একজন চিৎকার করছে, ’এসো তোমাকে উড়তে শেখাব। তোমার দুটো পাখা গজাবে। পরীর মতো মহাকাশে উড়ে বেড়াবে। মর্ত্যের মানুষকে এনে দেবে স্বর্গের বার্তা। এসো…। আমরা তোমাদের জন্যই এসেছি। এই ব্যবসা নিয়ে এসেছি।‘
দৌড়ে গিয়েছে রাণী, চম্পারা। খামছে ধরেছে সওদাগরের হাত। ওদের মুখে হিন্দি সিনেমার গানের কলি।
‘ও মেরী স্বপনো কী সওদাগর… মুঝে এইসি জায়গা লে যাওঁ… ।‘
সওদাগরের পরামর্শ মতো নিজেকে ক্ষীণাঙ্গী করে তুলেছে। দুপায়ে খাপ খেয়েছে উঁচু হিল। হাসতে শিখাছে…Fly high Airlinesএর দুটো পাখায় সাগর, মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে মজা নিয়েছে মেঘের। ওপর থেকে ক্ষুদ্র হয়ে পড়া ওদের ছোট শহরটার চেয়ে পৃথিবী্টাকে অনেক বড়ো বলে মনে হয়।
সওদাগর বলে, পরী হওয়াটা সহজ নয়। তোমার বুকের মাপ সঠিক হতে হবে।আবেদনময়ী হয়ে উঠতে হবে।বাজারে মেদবহুলতার কদর নেই।ওজন কমাও।‘
ওজন কমাবে? কত কমাবে? দুইমাসে দশ কেজি? সঠিক মাপে গড়তে চাওয়া শরীর? অন্য এক ব্যবসা মেলে অন্য এক সওদাগরের আহ্বান, ’দুমাসে দশ কেজি কমে যাবে। আমাদের কাছে এসো। মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা খরচ…’
বয়েল খাও, এক্সারসাইজ কর। নো জাঙ্ক ফুড…। সাইড অ্যাফেক্ট নেই। স্লিম হওয়ার ওষুধ খাও। সহজ নয়।শরীর গড়া সহজ নয়। এখন শরীরই সবচেয়ে বেশি দামি। মিস ইণ্ডিয়া হবে না? মিস ব্রহ্মপুত্র! মিস লুইত…। শরীরকে সুখী করলেই সুখী হবে তোমার আত্মা।সওদাগরেরা ওকে টেনে নিতে চায়।
কথা বলতে চাও? সারা রাত মরুভূমির মধ্যে, সাগরের বুকে থেকেও কথা বলতে পার যদি আমাদের কোম্পানির মোবাইল কানেকশন নাও…। অফার আছে, চুমু খাও, প্রেমালাপ কর…। ‘একশো কোটি গ্রাহকের বিশাল বাজার। বিগ বাজার। ভারী ভারের বোঝা নিয়ে দলে দলে সওদাগর। দরজার সামনে বাজার বসেছে। ফিট হয়ে উঠা দেহবল্লরী নিয়ে যেন ম্যাডোনার মতো চমকে উঠে! ব্রিটনি স্পেয়ার্স এর মতো চুলের বন্যা….।
দলে দলে সওদাগররা এগিয়ে আসে।give and take….’
এই শরীর সাজিয়ে রাখার জন্য নয়।ঘন্টা হিসেবে তুমি মূল্য পাবে।যদি বন্য ক্ষুধা পূরণ করতে পার। তা দেখে অনেকে চলে গেছে। কোথাও যেন ম্যাজিক ঘটে যায়। চমৎকার ঘটে যায়। কঠীয়াতলী গ্রামে বাপুরাম বরার ফোনটা বেজে উঠে।
‘বাবা, একটা নতুন কাজ পেয়েছি।’
‘কী কাজ, মা?’
‘একটা কোম্পানিতে।’
‘তোকে কী কাজ করতে হবে?’
‘ট্যুরে থাকতে হবে। গাড়ি বাড়ি দিয়েছে। পয়সাও অনেক। আমার জন্য আর ভাবতে হবে না।’
চমৎকার! মেয়েটি শুনতে পায় শুক্রবারের বাজারটাতে বাঁদর নাচানো গানের রিমেক! নতুন বাজনার লহরে বেজে ওঠে সেই সুর ।
ডুগ ডুগ ডুগ
নাচ কদমী নাচ
নাচ কদমী নাচ
কদমীরা নাচতে থাকে। নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে কদমীরা বৃহৎ এই মেলার বাজারে ঢুকে পড়ে। বেচা-কেনা। ক্রেতা-বিক্রেতা। উথপথপ….। দৌড়াদৌড়ি। টানা-হেঁচরা। কী নেই?
জীবন গড়ার সওদাগর! তাদের গ্যারান্টি আছে। না হলে টাকা ফেরৎ।
তাহলে দেরি কেন? এই দৌড়াদৌড়িতে এই সেদিন ও রাজেশ খনিকর হালের দুটো গরু বিক্রি করার দুঃখে আত্মহত্যা করেছে। ছেলে টাকা চেয়ে হুলুস্থূল করেছিল। তার একটা বাইক চাই। অতিষ্ঠ হয়ে হালের গরু বিক্রি করে দিল। গোয়ালঘরে নিজেও গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। তিনি বিগ বাজার কাকে বলে জানতেন না। রাজমাইর বাজারটাই তাঁর জীবনে দেখা সর্ববৃহৎ বাজার ছিল!
আলাদিনের প্রদীপ পৃ্থিবী আলোকিত করে তুলছে। যেখানে সেখানে আলাদিনের জিন।‘হুকুম করুন আকা….।
আকা হুকুম করে চলেছেন। জিন ও আকার ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার ভরিয়ে তুলছে।তা দেখে হেসে ফেলল চোখের আড়াল হয়ে পড়া একজন।খরগোসের মতো তার দুচোখ।রোদের রঙ শোষণ করে আকাশে গড়ে তোলা রামধেনুর পথে তার দিকে তাকিয়ে পার হয়ে যায় এক ঝাঁক পরী। তাদের প্রত্যেকের হাতেও আলাদীনের প্রদীপ।
‘তোমার ত্বককে যদি হাইওয়ে’ করে তুলতে চাও, সানস্ক্রীন মাখা। সূর্য দেবতা ছিটকে পড়বে। তুমি হয়ে উঠবে ওদের মতো….।‘
পেছন পেছন বিপাশা বসু। করিণা কাপুরদের দেখে তার হাসি পেয়ে গেল।
‘এভাবে পর, এভাবে পর, এভাবে খাও….এগুলি খাও….।
পথ দেখানোর জন্য আমি আছি। Follow me….।‘
কী আশ্চর্য! Follow me বলে সামনে থাকা লিডারের পেছনে সারি পেতে হাজার Follower। বিগ বাজারে প্রবেশ করে তারা উথপথপ লাগিয়েছে।
সিধে চুলকে কার্ল করেছে। কার্ল চুল সিধে করছে।
গোল্ড ফেসিয়াল, থাই মাসাজ করছে।
পিজ্জা, বার্গার খাচ্ছে ….। ড্রিঙ্কস করছে।
মায়ার বাজারে সত্যিই ওদের বিকেল হল। তেল, কাঠি কিছুই নেই। এখন তার কী গতি হবে….। বাজারে পথ হারানোর মতো অবস্থা…. শুক্রবারের বাজারটার কথা মনে পড়ে যায়। সে বলেছিল বাগানের সেই বাজারটাতে আরও নানা রকমের জিনিস বিনিময় হত। সজল দুই চোখ, হৃদয়ের বার্তা….প্রেম সমস্ত কিছু….। যেখানে কোনো মূল্য নিরুপিত হয়নি। এটাই সেই অবনী খুড়ো গাওয়া মায়ার বাজার! পথ হারানোর ভয়ে কাতর হয়ে সে তা হাতটা খামচে ধরে। সে তার দিকে এক পলকের জন্য তাকায়….। তারপর হেসে বলে, ফুলপাপড়ি যদি হৃদয় চাও, চল বাইরে যাই এই বিগ বাজার থেকে….। ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চল পথ খুঁজে নিই….।‘
খুব ভালো লাগলো।