বড় একা বরদি পাহাড়

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

ছোট্ট, ফুটফুটে একটা পাহাড়। সবুজের চাদরে মোড়া পরিবেশে একাকী দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়ে মায়ের মত বয়ে চলা কংসাবতী মাঝে মধ্যেই তার গালে এঁকে দিচ্ছে সস্নেহ চুম্বন। পাখির ডাক ছাড়া আবহ সঙ্গীতে অন্য কোনও শব্দ নেই। এমন সুন্দরের মাঝে একটা পলাশ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কেমন যেন ঘোর লেগেছিল। সম্বিত ফিরল একজনের ডাকে, ‘কি ভাবছ বাবু?’ তাকিয়ে দেখি ছোটখাটো কালোকুলো এক লোক। সত্যিই তো কি ভাবছি আমি? সুন্দরের ঘোরে ছিলাম বললে তো সে বুঝবে না। তাই অল্প হেসে মাথা নাড়লাম।

সে লোকের নাম কালু বাগদি। গরু চরাতে এসেছিল, আমায় দেখে খানিক গল্প করার সাধ জেগেছে। এই দেখুন সুন্দরের ঘোরে আমি তো জায়গাটার নাম বলতেই ভুলে গেছি। এসেছি বরদি পাহাড়ে। এখন অবশ্য বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ব্লকের বরদির সামান্য নাম ডাক হয়েছে। তাই কিছু মানুষ আসেন। কিন্তু আমি যখন থেকে বরদিকে চিনি তখন বরদি নিতান্তই অনাঘ্রাত, অনাস্বাদিত বলা যায়। ১৯৯৯ সালে প্রথম বরদিকে দেখি। দেখেই মুগ্ধ। সুবিশাল নয়, কিন্তু তার ক্ষুদ্রতার মধ্যেই আছে এক অন্য সুন্দরের হদিশ। বরদির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে গা ঘেঁসে বয়ে চলা কংসাবতী।

সম্প্রতি বরদির কোলে গড়ে উঠেছে থাকার আস্তানা। হয় তো ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য সুখবর। কিন্তু বরদির স্বাভাবিক নির্জনতা, সৌন্দর্য এতে খানিকটা কমবে বলেই আমার ব্যক্তিগত আশঙ্কা। রিসর্টের কর্ণধার বাপি চক্রবর্তী বিনয়ী মানুষ। কর্মীরাও খুবই পরিশ্রমী এবং ভাল। এখানে রাত্রিবাস করে আনন্দ মিলবে নিঃসন্দেহে বলা যায় তবে যারাই যাবেন তাদের কাছে আমার আগাম অনুরোধ রইল বরদির নির্জনতা এবং নিরিবিলি সৌন্দর্যের পরিপন্থী হয় এমন কিছু করবেন না। যাই হোক থাকার খোঁজ তো নেটেই মিলবে তাই ওই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। বরং আসি বরদিতে কি দেখবেন সেই প্রসঙ্গে।

বরদিকে আসলে পাহাড় বলাটা ঠিক হবে না। কারন এতে অন্য পাহাড়েরা একটু রাগ করতেই পারে। বাঁকুড়া জেলার অন্য পাহাড়গুলির তুলনায় আয়তন এবং উচ্চতায় বরদি নস্যি। শ দুয়েক ফুট উঁচু বরদির চুড়ায় উঠতে পরিশ্রম নেই বললেই চলে। কিন্তু চুড়ায় উঠে নদীর দিকে গেলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সবুজের গালিচা পাতা, তারই মাঝে একে বেঁকে বয়ে চলেছে কংসাবতী। কাজল কালো জলে বরদির ছায়া। পাথরের উপরে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই কেটে যায় অনেকটা সময়।

বরদির পিছন দিকে শাল মহুয়ার জঙ্গল। নুড়ি পাথরে মোড়া জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সেই পথে হাঁটতেও কিন্তু অপূর্ব লাগে। এখানেও পিছু ছাড়েনি নির্জনতা। এই নিরিবিলি নির্জনতাই বরদি পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যে অলঙ্কার পাখ পাখালির কুজন। শালের জঙ্গল দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে এসে এবার একটু বিশ্রাম। 

হয় তো তেমন কিছু নেই। কিন্তু আছে অনেক কিছু। চাইলে জলে নেমে স্নানও করে নিতে পারেন। আমিও অনেকক্ষণ বসে আছি পাথরের উপরে পাহাড়ের মাথায়। কালু আমার পিছু ছাড়েনি। পাশেই কালাপাথর গ্রামে তার বাড়ি। আমি কলকাতা থেকে এসেছি শুনে তো অবাক। প্রথমে মনে করেছিল আমি বিষ্ণুপুর বা বাঁকুড়ায় থাকি। পরে কলকাতার লোক শুনে খাতির যত্ন আরও বেড়ে গেল। ওর কাছেই শুনলাম থাকার জায়গা তৈরি হয়েছে, কলকাতার বাবুরা এসে থাকবে বলে।

বেলা বাড়ছে এবার উঠতে হয়,কালুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি এবার রওনা দিলাম সবুজ দ্বীপের দিকে। কংসাবতীর জল কম, তাই সহজেই পার হয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই সবুজ দ্বীপ। না হলে ফের অনেকটা ঘুরে যেতে হয় সবুজ দ্বীপে। এই নাম অবশ্য বেশি দিন হয়নি। এটা এতদিন সবুজ কুমারীই ছিল। বছর পাঁচেক হল স্থানীয় প্রশাসন দ্বীপটির সৌন্দর্যায়ন করে সবুজদ্বীপ নাম দিয়ে একটা পিকনিক স্পট বানিয়েছে। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে সবুজ দ্বীপ এখন কৃত্রিম সৌন্দর্যে বা মেক আপ নিয়ে সুন্দর হয়েছে। আমাকে তা মোটেই আকৃষ্ট করতে পারেনি। এখানেও একটি থাকার জায়গা আছে। সেখানে থাকা খাওয়ার যা দর শুনলাম তা বেশ কষ্টদায়ক। মোট কথা সবুজ দ্বীপ পাশেই বলে সেখানে যাওয়া হল বটে কিন্ত বরদি ছেড়ে এখানে এসে মন প্রাণ দুটোই খুব হোঁচট খেল।

এবার ফেরার পালা। আসা বা যাওয়ার কথা এবারে বলি। কলকাতা থেকে ট্রেনে বিষ্ণুপুর বা বাঁকুড়া এসে সেখান থেকে বাস ধরে বাঁকুড়া থেকে রাইপুরের রাস্তায় পড়ে পিড়রগাড়ি মোড়। সেখান থেকে খাতড়া যাওয়ার রাস্তায় ছ’কিমি দূরে চুয়াগাড়া মোড়। ওই মোড় থেকে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা ধরে চার কিমি গেলেই পাওয়া যাবে নেতুরপুর পঞ্চায়েতের কালাপাথর গ্রাম লাগোয়া বড়দি পাহাড়। খুব সকাল সকাল এলে দিনের দিন ফিরে যাওয়া সম্ভব। খাওয়া দাওয়া কাছেই পিড়রগড়ি মোড়ে পাবেন, এছাড়াও একটু এগিয়ে রাইপুরে গেলেও মিলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen + seventeen =

preload imagepreload image