সম্পাদকীয়, অক্টোবর ২০২১
“জিএসটি কাউন্সিল মনে করে, পেট্রোপণ্যকে জিএসটি-র আওতায় আনার এটা আদর্শ সময় নয়।” অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের এই ছোট্ট উক্তি বা বক্তব্য দেশবাসীর আশায় জল ঢেলে দিল। গোটা দেশের মানুষই প্রবল আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন লখনৌতে হওয়া জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকের দিকে। জোর গুজব ছিল পেট্রোল ও ডিজেলের দামকে জিএসটির আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে আলোচনা হবে। কেরালা হাইকোর্টের নির্দেশে বিষয়টি আলোচনাতে ওঠেও, কিন্তু সেই আলোচনার পরে অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্য হতাশ করেছে আমাদের সকলকেই।
সম্প্রতি একটি সমীক্ষা উল্লেখ করে ইকোনোমিক টাইমস জানিয়েছিল প্রতি ৫ জন ভারতীয়ের মধ্যে ৪ জনই চাইছেন, পেট্রোল-ডিজেলের উপর জিএসটি লাগু করুক কেন্দ্র। এতে জ্বালানির দাম তো বটেই, নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও অনেকটা কমবে বলেই মনে করছেন তাঁরা। ঐ সমীক্ষা বলছে, ৭৭ শতাংশ সাধারণ মানুষই জ্বালানিতে জিএসটি লাগুর পক্ষে। এই মুহূর্তে জ্বালানির উপর যদি ২৮ শতাংশ হারে জিএসটি লাগু হয়, তবে পেট্রোলের দাম দাঁড়াবে লিটার প্রতি প্রায় ৭৫ টাকা। ডিজেলের দাম হবে লিটার প্রতি ৬৮ টাকার মত। দাম কমলেই, এর একটা বিপুল প্রভাব পড়বে অর্থনীতির উপর। সাধারণ মানুষের খরচ করার প্রবণতা বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার উপরে রাজনৈতিক নেতাদের যে কোনও আবেগ বা দায়িত্ব কাজ করে না তা ফের বুঝিয়ে দিল এই সিদ্ধান্ত। কোভিড পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই জরাপ্রাপ্ত। সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই, কাজ নেই। সেই সময় দেশে জ্বালানীর দাম আকাশ ছোঁয়া। সকলেই চাইছিলেন তার সুরাহা হোক। কিন্তু সে আশায় জল ঢাললেন রাজনৈতিক নেতারা।
কেরালা, তামিলনাডু, দিল্লী, পঞ্জাব, গোয়া, মহারাষ্ট্রের মত বেশ কিছু রাজ্যের আপত্তিতে পেট্রোপন্যকে জিএসটির অন্তর্ভুক্ত করা গেল না এমনটাই দাবি কেন্দ্রের। কেন্দ্রের পেট্রোল ডিজেলের দাম কমানোতে সদিচ্ছা কতটা তা এতদিনে আমরা সকলেই বেশ বুঝে গিয়েছি। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার সময় বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১০৯ ডলার। আর ভারতে পেট্রোলের দাম ছিল লিটার পিছু ৭৯ টাকা ৩৬ পয়সা। এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলার, এবং দেশে পেট্রোলের দাম ১০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে মাস খানেক ধরে। ডিজেলের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। কেরালা হাইকোর্টের নির্দেশে জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে এই বিষয়টি তুলতে বাধ্য হলেও কেন্দ্রে বিজেপি সরকার কখনই খোলা মনে চায়নি পেট্রোপন্য সস্তা হোক। এবার রাজ্যগুলি আপত্তি তোলাতে কেন্দ্রের আরও সুবিধা হল। এবার তারা সহজেই বলতে পারছে যে রাজ্যের আপত্তিতেই তেলের দাম কমানো গেল না। বিজেপি কিন্তু এটাই চাইছিল। রাজ্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে জয়ের মুচকি হাসি তাদের মুখে।
বিরোধীরা তেলের দাম কমানো নিয়ে নানান লোক দেখানো আন্দোলন করেছেন, কুম্ভীরাশ্রু নিক্ষেপ করেছেন গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায়। রাহুল গান্ধী নিজে সাইকেলে চেপে সংসদে গিয়েছেন। কিন্তু জিএসটিতে জ্বালানী তেলের দাম অন্তর্ভুক্তির প্রসঙ্গ উঠতেই তারা রাজস্ব আদায় কম হওয়ার অজুহাতে রে রে করে উঠলেন। আমাদের বাংলা অবশ্য এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলেনি বলেই শুনলাম। কিন্তু অন্য বিজেপি এবং অবিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যই এ ব্যাপারে একবাক্যে না করে দিয়েছে।
একটা বিষয় এখান থেকে পরিস্কার, পেট্রোপন্যের দাম কমুক সেটা কেউই চায় না। মূল উদ্দেশ্য রাজস্ব আদায়, যেটা এখান থেকে খুব সহজেই কেন্দ্র ও রাজ্যের পকেটে আসে। বাকি পেট্রোপন্যের দাম বাড়লে প্রতিবাদ, আন্দোলন যে শুধুই নাটক তা আজ স্পষ্ট । দেশে যখন পেট্রোলের দাম ১০০ টাকা লিটার ছাড়িয়েছে, ডিজেলের দাম ১০০ টাকার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। তার ফলস্বরূপ বাজারে প্রত্যেকটি জিনিস অগ্নিমূল্য, তখনও কিন্তু দেশ এবং রাজ্যের অধিকাংশ অর্থমন্ত্রীরা মনে করেন পেট্রোল ডিজেলের দাম জিএসটিতে আনার এটা সঠিক সময় নয়। সেই সঠিক বা উপযুক্ত সময়টা ঠিক কখন আসবে সেই দিকে তাকিয়েই দিন তথা জীবন কেটে যাবে দেশবাসীর।
ভাল কাটুক পুজো আপনাদের। এই অতিমারির দুঃসময় কেটে যাক শীঘ্রই। পাশাপাশি কেটে যাক রাজনৈতিক শোষণ এবং শাসনের এই দুঃসহ জীবন যন্ত্রণার বিভীষিকা। মায়ের কাছে এটুকুই চাওয়া। ভাল থাকবেন। শুভ বিজয়ার আগাম নমস্কার, ভালবাসা, সকলের জন্য।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ