সম্পাদকীয়, এপ্রিল ২০২৩
খবরের কাগজে পড়ে বেশ একটু উত্তেজিতই হয়ে পড়েছিলাম। সত্যিই তো আমাদের হকের টাকা আটকে রাখার অধিকার তো কেন্দ্রের নেই। আমাদের প্রাপ্য টাকা আমাদের দিতেই হবে। পাশাপাশি টাকা না দিলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রেএক কোটি মানুষের সই সম্বলিত চিঠি পাঠানোর কথা বলেছেন সেটাও আমার দারুণ মনে ধরেছে। এটা দারুণ দাওয়াই। কিন্তু স্বল্প শিক্ষিত মানুষ তো আমি,,তাই একটা প্রশ্ন ছিল। আচ্ছা এই চিঠি পাঠানোয় কাজ হয়? সরকার এতে নড়েচড়ে বসে? কেউ কি একবারও ওই চিঠি খুলে পড়েন? একটা চিঠিরও উত্তর দেওয়া হয়? না আমি তথ্য জানার অধিকারের ভিত্তিতে পাঠানো চিঠির কথা বলছি না, তাতে যা হোক একটা উত্তর বোধ হয় আসে, কিন্তু এই যে সরকারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়, তার কোনও উত্তর সরকার বাহাদুর দেন? কে জানে। কিন্তু অভিষেকের চিঠি পাঠানোর এই দমদম দাওয়াইটা খুব কাজে আসবে, কি বলুন?
কিন্তু এই ওষুধটা কি সকলের কাজে আসে? এই যেমন গোবরডাঙার মানুষের কোনও কাজে আসেনি, জানেন তো? বুঝলেন না, আসলে গোবরডাঙা হাসপাতাল খোলার দাবি বা অনুরোধ জানিয়ে সেখানকার মানুষ নিজেদের সই করে আট হাজারেরও বেশি চিঠি নবান্নে পাঠিয়েছিলেন। খোলা পোস্ট কার্ডেই সেই চিঠি পাঠানো হয়েছিল, একটাই কথা লেখা ছিল বন্ধ হয়ে থাকা হাসপাতালটি স্থানীয় বহু মানুষের স্বার্থে খোলা হোক। কিন্তু না, সেই চিঠিতে কাজ কিছু হয়েছে কিনা গোবরডাঙার মানুষ তা টের পাননি। অবশ্য টের পাননি বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। কারন হাসপাতালের অন্য পরিষেবা তো প্রায় দশ বছর ধরে বন্ধই ছিল, এ বছরের শুরুতে টিম টিম করে চলা আউটডোরটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেকটা জায়গা জমি, বড় বড় বাড়ি নিয়ে এখনও খোলার আশায় দাঁড়িয়ে সেই হাসপাতাল। কি চিঠিতে কি কাজ হয় তাহলে?
আপনাদের একটু খুলেই বলি তাহলে। এই হাসপাতাল কিন্তু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনও হাসপাতাল নয়। এর বয়স নয় নয় করেও আশি বছর। ১৯৪৩ সালে তৎকালীন গোবরডাঙা টাউনহলে সূচনা হয় এই হাসপাতালের, তখন নাম ছিল ফেমিনিন এমারজেন্সি রিলিফ হাসপাতাল। দেশ স্বাধীন হলে গৈপুরে মিত্র ও বসু পরিবার হাসপাতাল স্থাপনের জন্য জমি দেয়। সেই জমিতে ১৯৫৭ সালে এটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসাবে পথ চলা শুরু করেছিল, ২০০১ সালে বাম আমলে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের হাত থেকে এই গ্রামীণ হাসপাতালের দায়িত্ব নেয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ। তার পর থেকেই ধীরে ধীরে হাসপাতালটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। অবশেষে ২০১৪ সালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের তরফ থেকে নোটিস দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, হাসপাতালে শুধুমাত্র আউটডোরে কিছু পরিষেবা চালু থাকবে। রোগী ভর্তি-সহ অন্যান্য সব পরিষেবাও বন্ধ থাকবে। এরপরেই গোবরডাঙা একাধিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিবাদ জানায় ও সরকারি মহলে ডেপুটেশন দেয়। কিন্তু লাভ হয়নি। চল্লিশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটি চালু হলে গোবরডাঙা পুর এলাকা এবং বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত এলাকার লক্ষাধিক মানুষ উপকৃত হবেন।
কিন্তু ২০১৭ সালের ৩১ মে ব্যারাকপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে বন্ধ থাকা গোবরডাঙা হাসপাতাল ফের চালু করার আর্জি জানিয়েছিলেন তৎকালীন পুরপ্রধান সুভাষ দত্ত। সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন স্থানীয় বিধায়ক পুলিন বিহারী রায়ও। কিন্তু প্রকাশ্য সভাতেই সুভাষবাবুর উচ্চারণভঙ্গিকে নকল করে ব্যঙ্গ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি জানিয়ে দেন গোবরডাঙায় হাসপাতাল হবেনা। তাদের প্রয়োজন হলে ৩০ কিলোমিটার দূরের বনগাঁ হাসপাতালে যেতে হবে। না হলে ৫০ কিলোমিটার দূরে কল্যানীতে এইমস হচ্ছে সেখানেও যাওয়া যেতে পারে। প্রকাশ্যসভায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যানকে ব্যঙ্গ করাটা গোবরডাঙার মানুষ ভালোভাবে নেননি। ভালো ভাবে নেননি রাজ্যের প্রধান অভিভাবক তথা একজন মুখ্যমন্ত্রীর হাসপাতালের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা দাবি এমন ভাবে নাকচ করে দেওয়াটাকেও। এই হাসপাতালকে বাঁচাতে গণতন্ত্রের শেষ হাতিয়ার বনধের রাস্তাও বেছে নেন গোবরডাঙাবাসী৷ ‘গোবরডাঙা পৌর উন্নয়ন পরিষদের’ ডাকে ১৪ জুন বনধ পালন করে গোবরডাঙা৷ এমন সর্বাত্মক বনধ গোবরডাঙাবাসী কেন গোটা বাংলাও বোধহয় সাম্প্রতিক কালে দেখেনি। ১২ ঘন্টা গোটা গোবরডাঙাই যেন স্তব্ধ ছিল। ট্রেন চলেছে কিন্তু গোবরডাঙা রেল স্টেশন ফাঁকা, স্কুল, ব্যাঙ্ক, দোকানপাট সব ছিল বন্ধ। ভ্যান রিক্সা চালকেরাও এদিন পথে নামেননি। যেখানে বন্ধ সফল করতে সমর্থকদের পথে নামতে হয়, বলপ্রয়োগ করতে হয়, হিংসার আশ্রয় নিতে হয়, সেখানে কিন্তু গোবরডাঙায় অরাজনৈতিক সংগঠনের ডাকা এই বনধে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিলেন সব শ্রেণীর মানুষ।
তার পরেও চালু হয়নি হাসপাতাল। মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে খসা কথা রাখতে এই হাসপাতাল চালু না হওয়ার সব রকম চেষ্টা করে গিয়েছে প্রশাসন। মাঝে কোভিডের সময় এই হাসপাতাল কোভিড হাসপাতাল বলে ব্যবহার করা হলে আশার আলো দেখতে পান স্থানীয় মানুষ। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব কমে যেতেই ফের বন্ধ হাসপাতাল। গোবরডাঙার পুরকর্তারাও হাসপাতাল নিয়ে মানুষের ক্ষোভের কথা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যেখানে বলেছেন যে এই হাসপাতাল চালু হবে না, সেখানে অন্য কেউ কি করে তা চালুর উদ্যোগ নেয় বলুন দেখি। তাই তো গোবরডাঙা পুরসভা সম্প্রতি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে মিলে পাশেই থাকা শিশু হাসপাতালে কিঞ্চিৎ পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন। ভাবুন এলাকায় অতটা জায়গা জমি নিয়ে বিশাল হাসপাতাল থাকা স্বত্বেও কাছেই ছোট্ট একটি শিশু হাসপাতালকে ব্যবহার করতে হচ্ছে, শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর মুখ রক্ষা করতে। ভাবুন তাহলে।
স্থানীয় মানুষ তখন মুখ্যমন্ত্রীকে তাদের দুর্দশার কথা জানাতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। একটি দুটি নয় আট হাজারেরও বেশি চিঠি গিয়েছে গোবরডাঙা থেকে নবান্নে। কিন্তু আরও খারাপ বৈ লাভ কিছু হয়নি। তাই বলছিলাম মাননীয় অভিষেকবাবু এক কোটি চিঠি পাঠিয়ে খুব কিছু হবে কি? আপনারাই তো কোনও চিঠি পড়েন বলে মনে হয় না, পড়লেও তার সুফল মেলেনা। তাহলে মোদি বাবুরও নিশ্চয়ই চিঠি পত্র পড়বার সময় নেই। একটা লাভ হয়তো হবে, মোবাইল চলে আস্র পর তো চিঠি লেখার অভ্যেস চলে গিয়েছে, কিছু গরীব মানুষ আপনার কথায় ভুলে ফের চিঠি লেখায় মন দেবেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে কি? সে তো আপনারাই জানেন।
একটু রাজনৈতিক লেখা হয়ে গেল বোধ হয়? তবে আমাদের জীবনে রাজনীতি এমন ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তাকে বাদ দিয়ে কিছু ভাবার উপায়ই নেই। যাই হোক সকলে ভাল থাকবেন। আবার কথা হবে আগামী সংখ্যায়।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ