সম্পাদকীয় (ফেব্রুয়ারি ২০২০)

আজকাল নতুন একটা ভয় তাড়া করে বেড়ায় আমাকে, অসম্মানের। পথে ঘাটে সর্বত্র অসম্মানের আশঙ্কায় কেমন যেন অস্বস্তির কুয়াশা ঘিরে রাখে আমাকে। যেখানে যাই, যার সাথেই মিশি ভয়টা কিন্তু পিছু ছাড়ে না। পরিচিতরা বলেন গায়ে না মাখলেই হল… কিন্তু কেন জানি না আমার গায়ে ওই আলগা অসম্মান বা অবহেলাগুলি লেগেই যায়। পাল্টা বলা মানেই অসম্মানের মাত্রা বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা, তাই নিরবতাই শ্রেয়। কিন্তু সেটাও বড় কষ্টকর। তাই লেগেই থাকে ভয়।

দুর্গাপুর আমার পুরনো কর্মস্থল। একটা প্রয়োজনে সেখানে গেছি। হঠাৎ সিটি সেন্টারে দেখা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে। আমি যখন দুর্গাপুরে ছিলাম তখন তাদের অনেকেই সাংবাদিক হয়নি, অনেককেই আমি চিনি না। এখনকার সব চেয়ে বড় দুটি টিভি চ্যানেলের বর্তমান সাংবাদিকেরা সেই সময় শিক্ষানবীশ। স্থানীয় একটি ছোট্ট সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিক হওয়ার চেষ্টা করছিল তারা। আমি তখন দুর্গাপুরের প্রথম টিভির স্টাফ রিপোর্টার, কলকাতার ছেলে বলেই জানে সকলে। তাই আমাকে ওই শিক্ষানবীশদের নাম ধরে ডাকার প্রশ্নই ছিল না। বেশ সমীহই করত তারা। সেদিন যখন দেখা হল, তখন অবাক হয়ে দেখলাম আমাকে নাম ধরে ডাকছে তারা। বড় চ্যানেলের সাংবাদিক তো তাই এখন বড়দের দাদা ডাকাটা বোধহয় আর অভ্যাসে নেই ওদের। যাই বলুন অনভ্যস্ত কানে এই ডাকটা আমি ঠিক নিতে পারছিলাম না। একটি মেলায় গেছি, উদ্বোধনে আসা বড়সর মন্ত্রীর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা। সে যখন বিরোধী নেতা তখন থেকেই আলাপ, ঘনিষ্ঠতা। বহু আড্ডা হয়েছে একসঙ্গে, নানা আন্দোলনের খবর করেছি আমি। সে কথা মন্ত্রীমশাই তার পারিষদদের বলছিলেনও, কত পুরনো আলাপ আমাদের। তবে এই হৃদ্যতা কিন্তু তুমিতেই ছিল একথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। গাড়িতে ওঠার আগে আমাকে বললেন অফিসে আসিস একদিন ভাই, জমিয়ে আড্ডা দেব। হঠাৎ কানে লাগল তুই সম্বোধনটা। শাসক দলের হোমড়া চোমড়া মন্ত্রী, তাই কি তুমির সৌজন্য আজ আর তার মনে নেই। আপনারা বলতেই পারেন আপন মনে করেই তিনি বলেছিলেন কিন্তু অতটা আপন আমি হতে পারিনি বোধহয়। আমি এমনিতেই নেতা/মন্ত্রী, পুলিশ এবং সাংবাদিকদের একটু এড়িয়েই চলি। যাদের সঙ্গেই কাজের সূত্রে আলাপ হয়েছে কাউকেই তুমির গণ্ডীটা অতিক্রম করে তুইতে যেতে দিইনি। নিজের সম্মান নিজের মত করেই বাঁচাতে চেয়েছি।
অটোচালকদের, থুড়ি অটোয়ালাদের সুব্যবহার তো সর্বজনবিদিত। তাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির সঙ্গে আমার যাবে না। যবে থেকে এটা বুঝেছি আমি অটোতে চাপি না। অটোয় না চাপলে আর অটোয়ালাদের সঙ্গে কথোপকথনে জড়াতে হয় না। এ জন্য প্রয়োজনে ১০ কিলোমিটারও আমি হাঁটতে রাজি। টোটোরাও এখন সেই দিকেই এগোচ্ছে। কিন্তু তাই বলে পালাবারও তো পথ নেই। বাস ট্রাম ট্রেন সব জায়গাতেই কিন্তু অসম্মানের পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে সহযাত্রী অথবা চালক কর্মীদের কাছ থেকে।

আসলে কেউই সামনের মানুষটির প্রাপ্য সম্মান বা মর্যাদা নিয়ে ভাবিত নয়। তাই তো আমরাও রিক্সাচালক, সবজি, মাছ বিক্রেতা বা ভিখারি এদের অনেকক্ষেত্রেই তুই সম্বোধন করি। আপনি বলার তো প্রশ্নই নেই তুমি সম্বোধন করবার কথাও ভাবি না। আধুনিক প্রজন্মের কাছেও আপনি সম্বোধনটা এখন নেই বললেই চলে। তারাও প্রথম আলাপেই তুমি করে কথা বলে কত অনায়াসে। সেদিন মেসেঞ্জারে একটি মেয়ে (২০/২২ বছর হবে) আমাকে স্যার সম্বোধন করে বলে, চাকরির ব্যাপারে একটু কথা বলতে চায়। আমি কি সাহায্য করতে পারি, জানতে চাইতেই দেখলাম সে তুমিতে নেমে এসেছে। এটা অসম্মান আমি বলব না, তবে অস্বস্তি তো বটেই। ইংরেজিতে আপনি তুমি বা তুই আলাদা করে কিছু নেই। তাই কি এ প্রজন্মের কাছেও নেই? কি জানি, তবে অন্য মানুষকে একটু সম্মান দিতে, নিজের সুস্থ সংস্কৃতিকে বা ঐতিহ্যকে চেনাতে হলে প্রথম আলাপ বা সম্বোধনেই তা স্পষ্ট হয়।

বাড়ি ফেরার পথে সেদিন ফলের দোকানে আপেল দেখে একটু নেওয়ার ইচ্ছে হল, ১১০ টাকার আপেল ১০০ টাকায় হবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর পেলাম আপনার কেনার সামর্থ্য নেই, শুধু শুধু দরাদরি করবেন না। সম্মান বাঁচিয়ে চলে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে হল। অর্থাৎ অন্যের কাছে আপনার সম্মানের কোনও মূল্য নেই। আমরা যখন নিজেকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে তুই বলি তখন ভাবি না পরের প্রজন্মও সেটাই অনুকরণ করবে। হচ্ছেও তাই। রাস্তাঘাটে তাই সর্বত্র নিজের সম্মান নিজেকেই বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়ে ঘুরতে হয়। বড় ভয় লাগে বহু কষ্টে অর্জিত এবং সঞ্চিত সম্মানটুকু এই বুঝি চুরি যায়।

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

One thought on “সম্পাদকীয় (ফেব্রুয়ারি ২০২০)

  • April 14, 2020 at 8:01 am
    Permalink

    সম্পাদক মহাশয়ের বক্তব্য পড়লাম l ভালো লাগলো l ওনার সঙ্গে আমিও একমত l ইদানিং বাজারে চালু হয়েছে, তুই বলার প্রতিযোগিতা l কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখছি, সহপাঠী সহ যে কোন ইয়ারের সিনিয়রদের সামান্যতম সম্মান দেয়া হচ্ছেনা l আমরা সিনিয়রদের সম্মান দিয়ে দাদা বা দিদি বলতাম l এখন কে কাকে ধারে ! আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় আমরা সমস্ত স্যার, সমস্ত ম্যাডামদের, এমনকি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর কে “দাদা ” সম্মোধন রীতি মেনে করতাম l কেউ কোনদিন কিছুই মনে করেননি l পরে, কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে একবার “প্রিন্সিপাল “পদের চাকরিতে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে পুরানো অভ্যাসমতো জনৈক ম্যাডামকে ম্যাডাম না বলে দিদি বলেছিলাম l তখন একজন কমবয়েসী ছোকরা আমার কাছে এসে জ্ঞান দিয়ে গেল কানেকানে -” ম্যাডাম কে ম্যাডাম বলুন l দিদি বললে উনি ফেল করিয়ে দেবেন “l যদিও জানি, যিনি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন, তাঁর ও আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা এক l তফাৎ তিনি চাকরি করেন, আর আমি চাকরি খুঁজছি l যাইহোক, যস্মিন দেশে যদাচার, দেরি না করেই শান্তিনিকেতন নিয়ম, যা আমার অভ্যাসে সম্পৃক্ত হয়েছিল, তা বাদ দিয়ে ম্যাডাম কীর্তনে মগ্ন হলাম l ভাবলাম, এক দেশের বুলি যে ভাবে অন্য দেশের গলিতে রূপান্তরিত হয়, হয়তো তাইই হলো l এছাড়া আর একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল – কলেজে চাকরি করার সময় (আমি বি এড ও পি টি টি আই উভয় বিভাগের প্রিন্সিপাল হিসাবে ) ছাত্র -ছাত্রীদের আপনি সম্মোধন করি l এতে ছাত্র ছাত্রীদের অভিযোগ, ‘স্যার আমরা আপনার ছেলে মেয়ের মতো l আমাদের তুমি বা তুই বলবেন l কারণ অন্য স্যারেরা আমাদের তুই বলেন l’
    বলে রাখি, আপত্তি থাকা সত্বেও আমি ওদের আপনি বলি l আপনি বলার মধ্যে দারুন সুখ খুঁজে পাই l ওদের কাছ থেকে বিশেষ সম্মান পাই l জেনেছি, সম্মান দিলে সম্মান পাওয়া যায় l এইভাবে আলেকজান্ডারের হাতে ছোট্ট দেশের রাজা পুরু বন্দি হবার পর আলেকজান্ডার জানতে চাইলেন – “আপনি আমার হাতে বন্দি l এখন আমার কাছে কী ধরণের ব্যবহার আশা করেন? ” পুরু বন্দি জেনেও দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিলেন -“আমি রাজার কাছে রাজার মতো আচরণ প্রত্যাশা করি l “এই কথা শুনে আলেকজান্ডার বন্দি রাজাকে বুকে টেনে নিয়ে আলিঙ্গন কর্রেছিলেন l
    তাই সম্পপাদক মহাশয় কে বলছি, জুনিয়র সাংবাদিক কী বললো তা না ভেবে, আপনি চলুন আপনার পথে l তাতেই জয় আসবে l সমাজের সবাই একসঙ্গে শিক্ষিত হবেনা, হতে পারেনা l আমাদের এখনও অনেকটা ববছর অপেক্ষা করতে হবে l

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven − two =