সম্পাদকীয় ( নববর্ষ সংখ্যা ২০১৯ )

ঘন বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বাঁক নিতেই সরু পথের রেখাটা উধাও। দিশাহীন হয়ে বাইক থামালো গৌতম। আমি এত কিছু লক্ষ্য করিনি। আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কেমন যেন বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বাইক থামতেই চমকে উঠলাম। কি হল?

গৌতম বলল আর যে রাস্তা নেই।

কিন্তু ওরা যে বলল যাওয়া যাবে?

সেটাই তো। গৌতম বাইক পাশে রেখে নেমে একটু এগিয়ে দেখতে গেল। ফিরে এসে জানাল, হ্যা আছে রাস্তা। পুকুরের পাশ দিয়ে যাওয়া যাবে। খানিকটা হেঁটে বাইকের সওয়ার হলাম। বাঁশগুলি কেমন যেন অন্য রকমের সরু সরু, কিন্তু বেজায় ঘন। এপাশ ওপাশ দেখার উপায় নেই। মাঝে মাঝেই পলাশের আগুনে বিস্তার। আঁকা বাঁকা সরু মাটির পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা দুই মুর্তি। একটু পরেই অস্ফুটে বলে উঠল গৌতম, ওই তো… চকিত দৃষ্টিতে দেখলাম মন্দিরখানি। চারিদিকে লাল পলাশের রেখা, মাঝে পাহাড়ের গা ঘেঁসে কয়েকটি ভগ্নপ্রায় মন্দির বা অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। কেউ কোথথাও নেই, শুধু একটি ভাঙা মন্দিরের চাতালে বসে এক ফোকলা বুড়ো। গরু চরাতে এসেছিল বোধ হয়, মার্চের রোদ থেকে বাঁচতে ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছে। অদ্ভুত শান্ত, নিরিবিলি, নির্জন জায়গাটিকে দেখা মাত্রই প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রায় বছর কুড়ি আগে এটাই ছিল গড় পঞ্চকোটের ছবি। গৌতম মানে আমার এক সময়ের সহকর্মী তথা পুরুলিয়া জেলার সাংবাদিকের কাছেই শুনেছিলাম পাহাড়ের কোলে এমন জায়গার কথা। আমার নামের তাৎপর্য বোঝাতে ও’ই বলল মার্চে একবার পুরুলিয়ায় আসুন দাদা। দেখবেন আপনার (পড়ুন পলাশের) মহিমা। চিরকেলে প্রকৃতি প্রেমিক আমি সেই নেমন্তন্ন ফেরাতে পারিনি। সুন্দর কিছু দেখবার আশায় ছুটে গিয়েছিলাম পুরুলিয়ায়। কিন্তু সুন্দরটা যে এতটা মোহময় হবে, এতটা মনোমুগ্ধকর হবে তা বুঝিনি।

 আমিও গুটি গুটি পায়ে  ভাঙা মন্দিরের দাওয়ায় দাদুর পাশে গিয়ে বসলাম। দাদুই আমায় জানাল এটি পঞ্চরত্ন মন্দির। পাহাড়ের উপরে নাকি একটা ঝরণা আছে, আছে গড়ের আরও ধ্বংসাবশেষ। আমি আর গৌতম বাইক দাদুর দায়িত্বে রেখে ঝরণা দেখতে গেলাম। কিন্তু পথ কই? খানিক পরেই এদিক ওদিক ঘুরে বুঝলাম আমাদের পক্ষে চিনে যাওয়া সম্ভব নয়। ব্যবস্থা করল দাদুই। একটা ছোট্ট ছেলেকে দেখে ডেকে বলল ঝরনার কাছে নিয়ে যেতে। চললাম আমরা, বন বাদাড় ভেদ করে, লতা পাতা সরিয়ে, উঠছি তো উঠছিই, ঝরণা আর আসে না। কচিটাকে জিজ্ঞাসা করলাম আর কত দূর। মাছি মারার মত হাত উড়িয়ে বলল এসে গেছি প্রায়। আরও মিনিট দশেক পর দেখা মিলল ঝরনার। ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে উঠে কি যে হতাশ হলাম তা আর বলবার নয়। ছোট্ট একটা নালা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জল। চেনা ঝরণার ছবি যা মাথায় ছিল তা মুছে গেল এই ঝরণা দেখে। তবে হ্যা, ঠান্ডা ওই জল গায়ে মাথায় মুখে দিতে খুব আরাম লাগল। একটু জিরিয়ে নিয়ে এবার উপরের ধ্বংসাবশেষ দেখার পালা। ছেলেটি বলল সামান্য নেমে বাঁ দিকে হাটতে হবে। চল তাহলে, যাওয়ার পথে নিচে তাকাতেই চোখটা আটকে গেল যেন। অনেকটা নিচে লালে লাল, মনে হল আগুন লেগেছে যেন। এই তাহলে পলাশের রূপ। সে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য, মুখে বর্ননা করা দায়। অবাক চোখে নির্বাক আমি। “কই চল…” অধৈর্য কচির ডাকে চেতনা ফিরল। মিনিট আটেক এগোতেই দেখলাম প্রাচীন মন্দিরের মত কিছুর ভগ্নাবশেষ। পাহাড়ের গায়ে নির্জনে একাকী দাঁড়িয়ে, কাদের আসার আশায়! খুব ভাল লাগছিল জায়গাটা, একটা তেতুল গাছের নিচে বসে পাহাড়ের নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমরা।

নেমে এসে দেখলাম দাদু বাইক পাহারা দিচ্ছে তখনও। কিছু টাকা দিতে চাইলাম নিল না। বলল এর জন্য আবার টাকা নেব কি? ছোট্টটাকে দশ টাকা দিলে সেও দুবার না না করে অবশ্য নিয়ে নিল। সেই আমার গড় পঞ্চকোট দেখা। ওখানেই দেখলাম এক ধরনের লতানে পলাশ গাছ, যার ফুলের আকার বেশ বড়বড়। এটা আর কোথাও দেখিনি। সেই প্রথম আমার রাশি রাশি পলাশ একসঙ্গে দেখা।

রাতে ছিলাম পাশেই একটি গ্রামে একজনের বাড়িতে। একটু গভীর রাতে উঠোনে নেমে দেখি রুপোলী আলোর বন্যা চারিদিকে। সামনে পঞ্চকোট পাহাড় ঠায় দাঁড়িয়ে। বাড়ির সঙ্গে লেগে থাকা পলাশ গাছের গায়েও জ্যোৎস্না আলোর মায়াবী প্রলেপ। সামনে গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া পথের রেখা। সব মিলিয়ে কি অসাধারণ যে লেগেছিল তা বলবার নয়। মনে আছে ঘুম ভুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেক অনেক ক্ষণ। ফিরে এসেছিলাম এক অনাস্বাদিত ভাল লাগাকে বুকে নিয়ে।   

গড় পঞ্চকোটে কাজের জন্য এখন প্রায়শই যেতে হয়। প্রতিবারই যাই আর একটা হাহাকার যেন বুকের মধ্যে দিয়ে আগল ভেঙে বেরিয়ে আসে। সৌন্দর্য সকলের জন্য, কিন্তু সকলে সৌন্দর্যের সাধ নিতে চাইলে বা শুরু করলে একটা সুন্দর কি ভাবে ধীরে ধীরে কুৎসিত হয়ে ওঠে তা গড় পঞ্চকোট আমায় দেখিয়ে দিয়েছে। সেই নির্জনতা এখন উধাও। মন্দিরের গায়ে পড়েছে উন্নয়নের পরশ। উন্নয়নের ছোঁয়ায় কালো পিচ ঢালা পথ এখন পহাড়ের নিচে পর্যন্ত। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে রিসোর্ট। গাড়ির পর গাড়ি ঢুকছে। একের পর এক দোকান পাট, হই চই। পলাশের মালা পরে সেলফি নেওয়ার আকুতি। চিনতে পারিনা আমার প্রথম দেখাতেই ভাললাগা বা ভালবাসার জায়গাটিকে। কষ্ট হয়, আক্ষেপ হয়। এমন উন্নয়ন কি চেয়েছিলাম?

এই তো সেদিন… পঞ্চকোটে গিয়ে তাপসের দোকানের সামনে গাড়ি রেখে বসে ছিলাম গাড়িতেই, গড় পঞ্চকোটের থেকে ভাল লাগছিল সঙ্গে আনা একটা বই। তাতেই ডুবে ছিলাম; হঠাৎ পাশ থেকে আওয়াজ – কিছু টাকা দাওনা বাবু। তাকিয়ে দেখলাম এক বৃদ্ধা টাকা চাইছেন। পাশে আরও কয়েকজন। মনে পড়ে গেল বহু বছর আগে সেই দাদুর কথা, অতক্ষণ বাইক পাহারা দিয়েও বলেছিল – “এর জন্য আবার টাকা নেব কি গো”। আজ তো এখানে এত মানুষ, এত উন্নয়ন; উন্নয়ন কি তবে মানুষকে ভিখারী বানায়? কে জানে। গড় পঞ্চকোট বলতে পারে, শহুরে মানুষের ভিড়ে যে আজ ফেমাস ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। আমি তো লেখক নই তাহলে হয় তো জেগে উঠত আমার কলম, বলে উঠত – দাও ফিরে সে গড় পঞ্চকোট, লহ এ উন্নয়ন।        

সকলকে শুভ বাংলা নববর্ষের অসংখ্য শুভেচ্ছা এবং ভালবাসা। অবেক্ষণ পত্রিকা আপনাদের জন্যই সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। সকলেই ভাল থাকুন, অবেক্ষণকে এভাবেই ভালবাসুন। আবার কথা হবে আগামী সংখ্যায়।

নমস্কারান্তে

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ     

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − thirteen =