সময়ের ক্লান্তিহীন পথিক : মৃণাল সেন
রবীন বসু, কসবা, কলকাতা
“তুমি সোনার কলস কাঁখে চলে যাও
আমি মাটির কলস ছাড়া পিপাসা জানি না।”
— বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
হ্যাঁ, তিনি কোন সোনার কলসের গল্প আমাদের শোনান নি, শোনান নি মিলনান্তক কোন কাহিনী ; তিনি শুনিয়েছেন মাটির কলসের গল্প, মাটির মনিষ, আকালের মানুষ, দুর্ভিক্ষের মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, কারখানার শ্রমিক আর প্রতিবাদী মানুষের গল্প। মধ্যবিত্ত জীবনের ভণ্ডামী, স্বার্থপরতা, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ তাঁর চলচ্চিত্রের উপজীব্য। তিনি মৃণাল সেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ক্লান্তহীন স্মার্ট এক যুবক পথিক। ৯৫ বছর বয়সে সদ্য প্রয়াত হলেন ( ১৯২৩- ২০১৮ )।
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক হয়েও তিনি অবলীলায় নিজস্ব ভুবন তৈরি করে নিয়ে ছিলেন। সময় ও সমাজ সচেতন মৃণাল সেন সব সময় নিজের মধ্যে একটা প্রশ্ন তৈরি করতেন, আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন সেলুলয়েডের বুকে নিজের মত করে। সেই অর্থে তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের এক অনুসন্ধানী নাগরিক পরিচালক। পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকে ষাটের শুরু তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের নান্দীপাঠ। “রাতভোর” (১৯৫৫) তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি হলেও “নীল আকাশের নীচে” (১৯৫৮) তাঁর প্রথম সফল ছবি। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছবিটি।
কিন্তু এরপর থেকে তিনি সিনেমার ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা- নীরিক্ষা শুরু করলেন। সাদামাটা একমুখো সরল গল্প তিনি কোনদিনই বলতে চাননি। গল্পের ভিতরের গল্প টেনে বের করার চেষ্টা করতেন। ঘটমান বর্তমানকে নিয়ে তিনি বেশি আগ্রহ দেখাতেন। তাই সত্যজিৎ রায়ের মত ধ্রুপদী সাহিত্য-নির্ভর চলচ্চিত্র মৃণাল সেন বানাতেন না। তিনি নিজেই চিত্রনাট্য লিখতেন, অনেক সময় একটা ছোটগল্পকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্য খাড়া করতেন। যেমন অমলেন্দু চক্রবর্তীর “অবিরত চেনামুখ” অবলম্বনে “একদিন প্রতিদিন” ছবি করেছেন। চির অতৃপ্ত এই পরিচালকের মধ্যে যেন এক খুঁতখুঁতে যুবক বাস করত। রাজনীতি, বেকারত্ব, সামাজিক শোষণ, সময়ের অভিঘাত ব্যক্তিকে কতটা বিড়ম্বিত করে তা তাঁর আকাশ কুসুম, কোরাস, পরশুরাম, পদাতিক, ইন্টারভিউ,একদিন প্রতিদিন ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়।
সত্তর দশকের উত্তাল সময়কে নিয়ে কলকাতা-৭১, খারিজের মত ছবি করেছেন। কলকাতার ভিতরের অলিগলি যেমন তিনি চিনতেন, তেমনই কলকাতার ভিতরের আর এক কলকাতাকে আবিষ্কার করেছেন। নাগরিক মানুষের ভিতরের ভেঙেপড়া মানুষকে টেনে বের করেছেন। আমাদের বহুস্তরীয় সমাজে মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধও বহুস্তরে বিন্যস্ত। সেই বহুরৈখিক জীবনকে তিনি শিল্পসম্মত ভাবে সেলুলয়েডে ধরেছেন। কখনও লং শট কখনও বা শর্ট কিংবা ক্লোজআপে চরিত্রকে ধরেছেন। মেকআপ করা তাঁর না-পছন্দ ছিল। একসময় খুব কম বাজেটে হিন্দী ছবি “ভুবন সোম” করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। অথচ ছবিটি শুধু জনপ্রিয় হয় নি ব্যাবসায়িক সাফল্যও পেয়েছিল। অন্যান্য যে সমস্ত হিন্দী ছবি পরিচালনা করেছেন, মৃগয়া, এক আধুরি কহানি, খন্ডহর, জেনেসিস, একদিন অচানক। ওড়িয়া ছবি, “মাটির মনিষ”। প্রেমচন্দের কাহিনী নিয়ে করেছেন তেলেগু ছবি “ওকা উরি কথা”।
তাঁর ছবি, ছবির চরিত্রাভিনেতা/অভিনেত্রী, পরিচালক হিসেব তিনি নিজে বহুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
সর্ব অর্থে ভারতীয় এই পরিচালক বিশ্বের দরবারে সত্যজিৎ রায়ের পর বাংলা ছবিকে সব চাইতে বেশি আলোকিত করেছেন। বিদেশী সম্মান ছিনিয়ে এনেছেন। রাশিয়া ফ্রান্সের সেরা চলচ্চিত্র সম্মান মৃণাল সেনের জন্য যেন বরাদ্দ থাকত। পেয়েছেন পদ্মবিভূষণ ও ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মান দাদাসাহেব ফালকে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত “মহাপৃথিবী” ছবির পর তিনি দশ বছর কোন ছবি করেন নি। ইতিমধ্যে ভুবনায়ন হয়ে গেছে, পাঁচিল ভেঙে দুই জার্মানি এক হয়ে গেল, রাশিয়ায় কমিউনিজম ধাক্কা খেল— এই সব প্রেক্ষিত পরিচালক মৃণাল সেনকে আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড় করাল। ছবি করলেন “অন্তরীণ” আর “আমার ভুবন”। এই দুই ছবিতে বিশ্ব মানবতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক মন্দা, এন আর আই সমস্যা ঘুরেফিরে এসেছে। আমরা যে এক অস্থির অবিশ্বাসী হৃদয়হীন টেকনোলজি নির্ভর সময়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাঁর দর্শকদেরও উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলেন। এই অসহায়তা থেকেই “আমার ভুবন” দিয়েই সময়ের ক্লান্তিহীন পথিক পরিচালক মৃণাল সেন তাঁর পরিচালনা জীবন শেষ করেন।